খোশমেজাজে: বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
অবশেষে সব কিছু নির্বিবাদে মিটল। সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণ আগাগোড়া পাঠ করে বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের সূচনা করলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। সেই বক্তৃতায় রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশংসা থেকে শুরু করে নতুন নাগরিকত্ব আইনের ( সিএএ) বিরোধিতা এবং রাজ্যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ও ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার (এনপিআর) কার্যকর না করার দাবি জানানো হয়েছে।
বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য তথা শাসক তৃণমূলের যে সব প্রশ্নে সংঘাত চলছে তাতে রাজ্যপালের মুখ দিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান এই বক্তৃতার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেওয়া হল বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। একই সঙ্গে এটাও বলা হচ্ছে যে রাজ্যপাল ধনখড় প্রতিনিয়ত সরকার তথা শাসক তৃণমূলকে সমালোচনায় বিদ্ধ করলেও তাঁর মুখ দিয়েই সরকারপক্ষ বিধানসভায় প্রশংসা নথিভূক্ত করালেন।
রাজ্যপাল এই ভাষণের বাইরে ‘নিজের কথা’ যোগ করেন কি না তা নিয়ে কৌতূহল ছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তিনি বৃহস্পতিবার দুপুরেও জানিয়েছিলেন সংবিধানের গন্ডির মধ্যে থেকে নিজের টিপ্পনি বা পর্যবেক্ষণ বলার অধিকার তাঁর আছে। কয়েকদিন আগে কেরলে একইভাবে মন্ত্রিসভার অনুমোদিত ভাষণ থেকে বেরিয়ে এসে সেখানকার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান মন্তব্য করেছিলেন, নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভাষণে তিনি যা পড়ছেন সেটা তাঁর নিজস্ব বক্তব্য নয়। তিনি এ বিষয়ে ভিন্নমত। ফলে ধনখড়ের ‘নিজের কথা’ বলতে চাওয়া নিয়ে একই সঙ্গে আগ্রহ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার ভাষণ-পর্ব মসৃণভাবে উতরে যাওয়ায় বিধানসভাও ছিল নিরুত্তাপ।
আরও পড়ুন: বিজেপির মিছিল ঘিরে ধুন্ধুমার, গ্রেফতার কৈলাস, মুকুল, সায়ন্তন
বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আবদুল মান্নান অবশ্য পরে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘রাজ্যপালের সঙ্গে সরকারের কি এমন কোনও বন্দোবস্ত হয়েছিল যে তিনি তাদের ভাষণ পড়বেন, তবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সেখানে কোনও কড়া কথা থাকবে না? কারণ এনআরসি, সিএএ এবং এনপিআর নিয়ে বক্তৃতায় যা বলা হয়েছে, তা সবই ভাববাচ্যে। সরাসরি নয়।’’ বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘যা হল সবই তৈরি করা নাটক। গট আপ। মুর্শিদাবাদে রাজ্যপালের জন্য কালো পতাকা আর শান্তিনিকেতনে হেলিকপ্টার— দুই বন্দোবস্ত রেখেই চলা হচ্ছে।’’
যদিও বৃহস্পতিবার রাতেই রাজভবন বিবৃতি দিয়ে জানায়, রাজ্যপাল সংবিধানের মধ্যে থেকে তাঁর বক্তৃতা পেশ করবেন। পাশাপাশি তিনি চান, প্রশাসন বা সংস্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষই আইনের গন্ডিতেই থাকুক। তখনই মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সংবিধানের সীমা মেনে ধনখড় মন্ত্রিসভার তৈরি করে দেওয়া বক্তৃতাই পড়বেন। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁকে পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। তবে বিধানসভা থেকে ফিরেই টুইটে রাজ্যপাল লেখেন, ‘‘সংবিধানের মহান ঐতিহ্য অনুযায়ী আমি বক্তৃতা করেছি। আশা করি, সকলেই সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করবেন।’’ তারপরেই তাঁর খোঁচা, ‘‘যাঁরা কর্তৃত্বে আছেন তাঁদের বলব, সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট হয় তেমন কোনও পদক্ষেপ করবেন না।’’
রাজ্যপাল বিধানসভায় পৌঁছন বেলা দুটো নাগাদ। প্রথমে অম্বেডকরের মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পরে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসে বিধানসভার লবিতে পা রাখেন তিনি। দরজায় অপেক্ষায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যপালকে পুস্পস্তবক দিয়ে স্বাগত জানান তিনি। মিনিট খানেক হাসিমুখে সৌজন্য বিনিময় হয় দু’জনের। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘‘ফার্স্ট লেডি ( রাজ্যপালের স্ত্রী) এলেন না কেন?’’ ধনখড় হেসে জানান, ‘‘তাঁকে তো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।’’
প্রথামাফিক শোভাযাত্রা করে অধিবেশন কক্ষে ঢোকেন রাজ্যপাল। জাতীয় সংগীতের পরে শুরু হয় তাঁর বক্তৃতা। এদিন সভা ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। প্রায় সওয়া এক ঘন্টা ভাষণে প্রতিটি শব্দ মিলিয়ে দেখতে উদগ্রীব ছিলেন বিধায়কেরা। কারও হাতে ইংরেজিতে মূল বক্তৃতার বয়ান, কারও হাতে বাংলা অনুবাদ। লিখিত শব্দের বাইরে যদি ধনখড় কিছু বলছেন কি না নজর ছিল সেদিকেই। বই দেখছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও।
রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য ছিল তাঁর বক্তৃতায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে প্রথমেই ছিল আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন। রাজ্যপাল বলেন, ‘‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বিগত বছরে রাজ্যে আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোনও গুরুতর অশান্তির ঘটনা ঘটেনি। সারা রাজ্যে সাম্প্রদায়িকত সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ছিল।’’ জঙ্গলমহল এবং পাহাড়ে শান্তি- সম্প্রীতির কথা বলেন তিনি।
বক্তৃতার শেষ পর্বে আসে সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর প্রসঙ্গ। রাজ্যপাল পড়েন, ‘‘এই মুহূর্তে আমাদের দেশ একটি সংকটজনক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান প্রণেতারা যে নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধগুলিকে সমুচ্চ স্থান দিয়েছিলেন সেগুলি আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।’’ তিনি বলেন, ‘‘শতাব্দী প্রাচীন ধর্মীয় বহুত্ববাদের ঐতিহ্য আজ গণতন্ত্রের মুখোশধারী গরিষ্ঠতাবাদের স্বৈরাচারের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সিএএ প্রত্যাহারের দাবি সহ রাজ্যে এনআরসি, এনপিআর কার্যকর না করার সরকারি সিদ্ধান্তও রাজ্যপাল বক্তৃতায় জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, চতুষ্পার্শ্বে অসহিষ্ণুতা, ধর্মান্ধতা ও বিদ্বেষের হাওয়া আজ এদেশের বহুবিধ ভাষা, ধর্ম ও জাতিগত সত্বার বৈচিত্র্যময় ঐক্যের কাঠামোকে নষ্ট করছে।’’
দীর্ঘ বক্তৃতার শেষে রীতিমাফিক শোভাযাত্রা করে সভাকক্ষ থেকে বেরনোর আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আবার কথা হয় রাজ্যপালের। এবার ধনখড়কে মমতা বলেন, ‘‘অনেকক্ষণ বক্তৃতা করেছেন। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। একটু চা খেয়ে যান।’’ শোভাযাত্রার পথ থেকে ঘুরে রাজ্যপাল স্পিকারের ঘরে চা খেতে যান। সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে পরে হাজির হন মুখ্যসচিব সহ আরও কয়েকজন। প্রায় আধঘন্টার চা চক্র সেরে রাজ্যপালের কনভয় রওনা রাজভবনের দিকে।