শুভেন্দুর গলায় আক্রমণের সুর। ফাইল চিত্র।
রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপে আনন্দই পাচ্ছিল বিজেপি। সমালোচনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু রামনবমীর মিছিল ঘিরে অশান্তি এবং তার প্রেক্ষিতে রাজ্যপালের ভূমিকায় সেই ‘আনন্দ’ যেন আবার কমতির দিকে। শনিবার বনগাঁয় একটি অনুষ্ঠানে শুভেন্দু বলেন, “গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও জগদীপ ধনখড়ের মতো ভূমিকা ওঁর মধ্যে এখনও দেখিনি।’’ রাজ্যপালের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘চেয়ারে যিনিই থাকুন তাঁকে রাজ্যপালের মতো কাজ করতে হবে।’’ তবে মূল সুরটা ছিল, প্রাক্তন দুই রাজ্যপালের সঙ্গে আনন্দের তুলনা। শুভেন্দু বলেন, ‘‘সংবিধান রক্ষা করতে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী এবং জগদীশ ধনখড়কে তৎপর হতে দেখেছি। কপ্টারে চড়ে আর্ত মানুষকে বাঁচাতে ছুটে যেতে দেখেছি ধনখড়কে। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী এবং জগদীশ ধনখড়ের মতো ভূমিকা তো তিনি (আনন্দ বোস) এখনও পর্যন্ত নেননি।’’
রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল শুভেন্দুর। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, ধনখড়ের যে সব পদক্ষেপকে অনেকে ‘অতি সক্রিয়তা’ বলত, সেটাই ছিল শুভেন্দুর অস্ত্র। ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে শুভেন্দু চেয়েছিলেন রাজভবনে কোনও দ্বিতীয় ধনখড় আসুন। কিন্তু সেটা না হওয়ায় প্রথম থেকেই ক্ষুব্ধ হন শুভেন্দু। তা বার বার তাঁর কথায় প্রকাশ পায়। কিন্তু পরে সেই পরিস্থিতির বদল হয়।
রাজ্যপালকে ঘিরে বিতর্কের শুরুটা আনন্দের শপথগ্রহণের দিনেই। প্রথম সারিতে বিরোধী দলনেতার আসন না থাকায় অনুষ্ঠান বয়কট করেছিল বিজেপি। রাজভবনে আসা ইস্তক রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে ‘সুসম্পর্কেরই’ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সরস্বতী পুজোর দিন বাংলায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। সে অনুষ্ঠানও ঘোষিত ভাবে বয়কট করেছিলেন শুভেন্দু। বয়কটের কারণ হিসাবে টুইট করে জানান, মনে হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে রাজ্য সরকার। লিখেছিলেন, ‘‘ঠিক যেন অশ্লীল কোনও বইকে ঝকঝকে মলাট দেওয়ার মতো কাজ করা হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, বিকেল ৫টার অনুষ্ঠান রাজ্যপালের চেয়ার এবং রাজভবনের মর্যাদাকে বাড়াবে না।’’
আনন্দ বাংলায় আসেন গত বছরের ২৩ নভেম্বর। আর গত জানুয়ারি মাসে রাজভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রাজ্যপালের। সেই বৈঠক নিয়ে এগরায় দলীয় সভায় শুভেন্দু বলেন, ‘‘সংবিধানের রক্ষক হচ্ছে বিচারব্যবস্থা আর রাজভবন। রাজ্যের পীড়িত জনগণের মনে রাজ্যপালের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। তা নষ্ট করতে নাটক করা হয়েছে। রাজ্যপালের (বৈঠকে) থাকা উচিত ছিল না।’’
এর পরে দু’টি টুইটে শুভেন্দু রাজ্যপালের সমালোচনা করেছিলেন। রাজভবনের একটি অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন রাজ্যের শিক্ষাসচিব মনীশ জৈনের স্ত্রী রুচিরা জৈন। তা নিয়ে টুইটে শুভেন্দু রাজ্যপালকে অনুরোধ জানান, অন্য শিল্পীরাও যাতে সুযোগ পান। এর পরে সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে সাম্মানিক ডি লিট প্রদান অনুষ্ঠানে রাজ্যপালের ভাষণ নিয়েও কটাক্ষ করেন শুভেন্দু। রাজ্যপাল আনন্দ বোস ওই অনুষ্ঠানে অটলবিহারী বাজপেয়ী, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, উইনস্টন চার্চিল, এপিজে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মমতাকে এক বন্ধনীতে রেখে প্রশংসা করেছিলেন। এর পরেই টুইটারে শুভেন্দু লেখেন, ‘‘রাজ্যপালের ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল, যেন উনি রাজ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন শুরুর আগে যে ঔপচারিক বক্তৃতা দেবেন, তারই মহড়া দিলেন।’’
পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় পৌঁছয় যে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার রাজভবনে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক আনন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরে বিজেপি শিবিরে ‘আনন্দ’ ফেরে। এর পরেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজ্যপালের কড়া বিবৃতি, প্রধান সচিব পদ থেকে নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেন। তবে এর পরেও বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের বক্তৃতা নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। নিজের বক্তৃতায় বোস রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশংসাসূচক অনুচ্ছেদ পড়া শুরু করতেই বিরোধীরা প্রতিবাদ জানান। শুভেন্দুর নেতৃত্বে ‘লজ্জা, লজ্জা’ ধ্বনি তুলে কক্ষত্যাগ করে বিজেপি। পরে শুভেন্দু বলেন, ‘‘রাজ্যপালকে অনুরোধ করেছিলাম, অসত্য ভাষণ না পড়ে তা ‘টেবিল’ করে দিতে। তিনি তা না করায় ভিতরে-বাইরে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।’’
সেই আবহ কি আবার ফিরে এল? রামনবমীর মিছিল ঘিরে অশান্ত হাওড়া প্রসঙ্গে শুক্রবার রাজ্যপাল বিবৃতি জারি করে বলেন, প্রতি মুহূর্তের ঘটনা জানতে রাজভবনের তরফে বিশেষ সেল খুলেছেন রাজ্যপাল। সেখানেই বলা হয়, রাজ্যপাল হাওড়ার ঘটনা নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছেও রিপোর্ট চেয়েছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি ‘একান্ত’ আলোচনা করেন।
একই সঙ্গে কিছুটা ভারসাম্য রেখেই রাজ্যপাল বিবৃতিতে লেখেন, ‘‘যাঁরা অশান্তি তৈরি করে ভাবছেন লুকিয়ে থাকবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।’’ প্রশাসন যে সঠিক পদক্ষেপ করে দোষীদের আইনের কাঠগড়ায় নিয়ে আসবে, সে কথা স্মরণ করিয়ে রাজ্যপাল লেখেন, ‘‘সরকারি সম্পত্তিতে আগুন, সেটাও আবার রামনবমীর মতো পবিত্র দিনে। এটাকে কড়া ভাবে দেখবে রাজ্য প্রশাসন।’’ এই প্রসঙ্গে ধর্মস্থাপনে হনুমানের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন আনন্দ। লেখেন, ‘‘ধর্ম রক্ষার জন্য হনুমান লঙ্কায় আগুন লাগিয়েছিলেন। আর অধর্মের জন্য যাঁরা আগুন লাগিয়েছেন, তাঁদের আগুন গিলে খাবে। যাঁরা এতে উস্কানি দিয়েছেন তাঁদের পরিণতিও একই হবে।’’ সেই সঙ্গে জানান, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হওয়ার প্রসঙ্গ। সেখানেই জানান, রাজ্য প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রী সে ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুইট করেন শুভেন্দু। তাতে সে ভাবে সমালোচনা না করলেও শনিবার বনগাঁর সভায় খোলাখুলি সমালোচনা করেন শুভেন্দু। অতীতেও তিনি দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার কাছে আনন্দের ভূমিকা নিয়ে নালিশ জানিয়েছিলেন। শনিবারও বলেন, ‘‘বর্তমান রাজ্যপাল কী করবেন সেটা তাঁর বিষয়। আমার কিছু অপছন্দ হলে তা বলার জায়গা আছে।’’