হাওড়ায় অশান্তির পরিস্থিতি নিয়ে তৎপর রাজ্য। — ফাইল চিত্র।
হাওড়ায় অশান্তির ঘটনার প্রেক্ষিতে নতুন নজির তৈরি করলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। প্রতি মুহূর্তের ঘটনা জানতে রাজভবনের তরফে বিশেষ সেল খুলেছেন রাজ্যপাল। সাম্প্রতিক অতীতে তো বটেই, এমনকি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো ‘উত্তাল’ সময়েও রাজভবনের তরফ থেকে এমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজভবনের প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, হাওড়ার ঘটনা নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছেও রিপোর্ট চেয়েছেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুক্রবার তিনি ‘একান্ত’ আলোচনা করেন বলেও জানিয়েছেন রাজ্যপাল আনন্দ।
বৃহস্পতিবার রামনবমীর মিছিল হাওড়ার কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। সেই পরিস্থিতি শুক্রবারেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। শুক্রবারেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ফোন আসে রাজভবনে। সেই ফোনের পরেই মমতার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে কিছু জানাননি রাজ্যপাল। তবে জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর একান্তে কথা হয়েছে। রাজভবনের বিবৃতিতে হাওড়ার ঘটনার নিন্দা করা হয়েছে। সঙ্গে সমালোচনা করা হয়েছে পুলিশের ভূমিকারও।
তবে শুধু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বা পুলিশের সমালোচনাই নয়, রাজ্যপাল তাঁর প্রেস বিবৃতিতে হিংসারও নিন্দা করেছেন। লিখেছেন, ‘‘যাঁরা অশান্তি তৈরি করে ভাবছেন লুকিয়ে থাকবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।’’ প্রশাসন যে সঠিক পদক্ষেপ করে দোষীদের আইনের কাঠগড়ায় নিয়ে আসবে, সে কথা স্মরণ করিয়ে রাজ্যপাল লেখেন, ‘‘সরকারি সম্পত্তিতে আগুন, সেটাও আবার রামনবমীর মতো পবিত্র দিনে। এটাকে কড়া ভাবে দেখবে রাজ্য প্রশাসন।’’ এই প্রসঙ্গে ধর্মস্থাপনে হনুমানের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন আনন্দ। লেখেন, ‘‘ধর্ম রক্ষার জন্য হনুমান লঙ্কায় আগুন লাগিয়েছিলেন। আর অধর্মের জন্য যাঁরা আগুন লাগিয়েছেন, তাঁদের আগুন গিলে খাবে। যাঁরা এতে উস্কানি দিয়েছেন তাঁদের পরিণতিও একই হবে।’’
এমন লেখার পাশাপাশি রাজ্যপাল কিছুটা ভারসাম্য রেখে পুলিশ, প্রশাসনকেও সতর্ক করেছেন। অন্যায় করে কেউ যাতে লুকিয়ে বাঁচতে না পারে সে কথা স্মরণ করিয়ে রাজ্যপাল লেখেন, ‘‘পুলিশের উচিত লক্ষ্য স্থির রেখে কড়া এবং স্বচ্ছ পদক্ষেপ করা। অশান্তি তৈরির পিছনে যাঁদের মদত রয়েছে তাঁদের ভয় পেলে চলবে না।’’ এর পরেই তিনি জানান রাজভবন পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রাখছে।
এর পরেই জানান মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হওয়ার প্রসঙ্গ। সেখানেই জানিয়েছেন, রাজ্য প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রী সে ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাস পাওয়ার পরেও তিনি মুখ্যসচিবের থেকে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এবং রাজভবনের বিশেষ সেল খোলার কথা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, হাওড়ার অশান্তিতে পুলিশের একাংশেরও যে ‘গাফিলতি’ ছিল, তা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনও বলেছিলেন যে, ‘দোষী’ পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনিক স্তরে ব্যবস্থা নেবেন। শুক্রবার সকালেই মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। সংখ্যালঘুরা যেন তাঁর উপর ভরসা রাখেন। তিনি বিষয়টি দেখছেন। মমতা বলেন, ‘‘আপনারা আমার উপরে ভরসা রাখুন। আমি নিজে বিষয়টি দেখছি। আমি কারও কোনও ক্ষতি হতে দেব না।’’
তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেও শুক্রবার এমন ইঙ্গিত মিলেছে যে, পুলিশ-প্রশাসনের একটি অংশ হাওড়ায় তাদের ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করতে পারেনি। কিন্তু তার পাশাপাশিই অভিষেক বলেছেন, এমন ঘটনা বৃহস্পতিবার সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ঘটেছে। বাংলায় কয়েকটি এলাকায় বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে, বাংলার সিংহভাগ এলাকাই শান্ত ছিল। বরং দেশের অন্য বিভিন্ন রাজ্যে ১০০ থেকে ১৫০টির মতো ঘটনা ঘটেছে। অভিষেক বলেন, ‘‘যারা গোলমাল করে, তারা কেউ হিন্দু, মুসলিম, শিখ বা খৃষ্টান নয়। তারা দুষ্কৃতী।’’
হাওড়ার ঘটনা নিয়ে বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী এনআইএ তদন্ত দাবি করেছেন। তিনি শুক্রবার হাওড়ার ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। তার পরে তিনি হাওড়ার পুলিশ কমিশনারেটে একটি সিডি জমা দিয়ে আসেন। শুভেন্দুর দাবি, ওই সিডি-তে প্রকৃত দোষীদের ছবি রয়েছে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ শুক্রবার রাজ্যপালের পাশাপাশিই বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকেও ফোন করেন। তবে তিনি রাজ্য বিজেপিকে কোনও নির্দেশ দিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। সুকান্ত বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবেই ফোন করেছিলেন অমিত শাহজি। দেশের যে কোনও জায়গায় শান্তি বজায় রাখাই কেন্দ্রের নীতি। তিনি বাংলার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। প্রকৃত পরিস্থিতি আরও বিস্তারিত জানতেই আমায় ফোন করেছিলেন।’’ আনন্দের সঙ্গে শাহের কী বিষয়ে কথা হয়েছে, তা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তার পরে পরেই বিবৃতি জারি করে রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছেন রাজ্যপাল। একই সঙ্গে নজরদারি সেল তৈরির কথাও জানিয়েছেন।