আরজি কর-কাণ্ডে শনিবার শিয়ালদহ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সঞ্জয় রায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর মামলায় আদালতের রায়ে শনিবার দোষী সাব্যস্ত হলেন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। কিন্তু আদালতের বাইরে ‘দ্বন্দ্ব এবং বিতর্ক’ রয়েই গেল। অপরাধী কি সঞ্জয় একাই? না কি একাধিক? না কি অপরাধী সঞ্জয় নন? অন্য কেউ বা কারা?
সঞ্জয়কে দোষী ঘোষণার পরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির একাংশ ‘লজেন্স’ দেওয়া হল, সঞ্জয়কে ‘বলির পাঁঠা’ করা হল ইত্যাদি বলতে শুরু করেছে। আদালত চত্বরে বিক্ষোভ এবং মিছিল শুরু হয়েছে এই দাবিতে যে, ওই ঘটনায় সঞ্জয়ই ‘একমাত্র’ দোষী নন। আদালতে সঞ্জয়ও বলেছেন, তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ফলে বিচার শেষের পরেও বিতর্ক রয়েই গেল।
প্রসঙ্গত, প্রথমে কলকাতা পুলিশ এবং পরে সিবিআই— দুই সংস্থার তদন্তেই একমাত্র অপরাধী সঞ্জয়ই। সিবিআইয়ের পেশ করা প্রাথমিক চার্জশিটে একমাত্র সঞ্জয়কেই অভিযুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। গত সপ্তাহে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার বিচার শেষ হয়। প্রায় দু’মাস ধরে ‘ইন ক্যামেরা’ (লোকচক্ষুর অন্তরালে) বিচার চলার পর দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সঞ্জয়। কিন্তু বিতর্ক এবং প্রশ্ন শেষ হয়নি।
তর্ক-বিতর্ক এবং প্রশ্ন
সিভিক ভলান্টিয়ারই একমাত্র অভিযুক্ত— এই তথ্য মানতে নারাজ নির্যাতিতার বাবা-মা। সিবিআইয়ের তদন্তেও কিছুটা ‘আশাহত’ ছিলেন তাঁরা। আরজি করের মতো একটি জনবহুল হাসপাতালে বাইরের কেউ ঢুকে এই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল এবং হাসপাতালের কেউই তা জানতে পারলেন না— এই ‘তত্ত্ব’ বিশ্বাস করতে চাইছেন না তাঁরা। তাঁদের সন্দেহ, সিবিআই প্রমাণ করতে চেয়েছে, ধৃত সঞ্জয়ই একমাত্র দোষী। আরও কারা জড়িত, তা জানতে ঘটনার আরও তদন্ত চান সন্তানহারা দম্পতি। এ নিয়ে প্রথমে কলকাতা হাই কোর্ট এবং এখন সুপ্রিম কোর্টেরও দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা।
সংশয় আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের মনেও। তাঁরাও মনে করছেন, ওই ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত রয়েছেন এবং তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। জুনিয়র ডাক্তার আসফাকুল্লা নাইয়ার দাবি, সিভিককে ‘বলির পাঁঠা’ করা হয়েছে। অনিকেত মাহাতোরও বক্তব্য, এক জনের পক্ষে এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। কী উদ্দেশ্যে এই অপরাধ হয়েছে এবং কারা জড়িত, তা খুঁজে বার করার দাবি তুলছেন তাঁরা।
যদিও বিচার শুরুর আগে পর্যন্ত নিম্ন আদালত বা সুপ্রিম কোর্টে সিবিআইয়ের আইনজীবীরা যা যা তথ্য তুলে ধরেছেন, তাতে ধর্ষণ এবং খুনে একাধিক জনের জড়িত থাকার আভাস মেলেনি। দিল্লির এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল সিবিআইকে যে অভিমত পাঠিয়েছে, তাতে নির্যাতিতার শরীরে থাকা আঘাতের চিহ্ন বিশ্লেষণ করে হয়েছে। তাতে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এক জনের পক্ষেও এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব। তবে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদনের সঙ্গে ঘটনার তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে দেখার পরে এ বিষয়ে ‘নিশ্চিত’ হওয়া যাবে বলে মত ওই বিশেষজ্ঞ দলের।
সঞ্জয়ের দাবি
এক বা একাধিক অভিযুক্তের জড়িত প্রশ্ন উঠে এসেছে সঞ্জয়ের আইনজীবীর সওয়ালেও। সম্প্রতি শিয়ালদহ আদালতে সঞ্জয়ের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, আরজি করের ঘটনা এক জনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। সঞ্জয় নিজেও দাবি করেছিলেন তিনি ‘নির্দোষ’। শিয়ালদহ আদালত চত্বরেই এক দিন প্রকাশ্যে চিৎকার করে সঞ্জয় দাবি করেন, ‘আসল’ অভিযুক্তদের বাঁচাতে তাঁকে ‘ফাঁসানো’ হচ্ছে। আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিজ়ন ভ্যানের জানালা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি এত দিন চুপচাপ ছিলাম। আমি কিন্তু রেপ (ধর্ষণ) অ্যান্ড (এবং) মার্ডার (খুন) করিনি। আমার কথা শুনছে না। সরকারই আমাকে ফাঁসাচ্ছে।” এর আগেও শিয়ালদহ আদালতের বিচারকের কাছে সঞ্জয় দাবি করেন, ঘটনার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি কিছুই করেননি।
সঞ্জয়কে গ্রেফতারের পর তাঁর পলিগ্রাফ পরীক্ষা করায় সিবিআই। আদালতের অনুমতি নিয়েও পরীক্ষা হয়। সূত্রের খবর, সে সময়ে তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তদন্তকারীরা। তাই পরে আবার সঞ্জয়ের নার্কো পরীক্ষা করাতে চেয়েছিলেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। তবে ধৃতের সম্মতি না থাকায় ওই আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত।
কী ভূমিকা সন্দীপদের
ধর্ষণ-খুনের মামলায় গত ৭ অক্টোবর শিয়ালদহ আদালতে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই। ওই মামলায় আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং খুনে জড়িত থাকার কোনও প্রত্যক্ষ যোগ পাননি তদন্তকারীরা। ঘটনার পর তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। যদিও সেই মামলায় দু’জনেই জামিন পেয়েছেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত এখনও চলছে। অভিজিৎ বর্তমানে জেলমুক্ত। তবে আরজি করের আর্থিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত সন্দীপ ওই মামলাতেই এখনও জেলবন্দি।
জুনিয়র ডাক্তারেরা মনে করছেন, সঞ্জয় দোষী সাব্যস্ত হওয়া মানেই ন্যায়বিচার নয়। কারা তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করলেন বা ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা করলেন, তা-ও তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা চাইছেন সিএলএসএফ রিপোর্ট, ডিএনএ পরীক্ষা-সহ বিভিন্ন রিপোর্টে ‘অসঙ্গতির’ তদন্ত করে বাকি দোষীদেরও চিহ্নিত করা হোক।
আসবে আরও চার্জশিট
সিবিআইয়ের প্রাথমিক চার্জশিটে সঞ্জয়কেই একমাত্র ‘অপরাধী’ বলা হলেও মামলার তদন্ত এখনও চলছে। ওই চার্জশিটেই তদন্তকারী সংস্থা জানায়, ঘটনার নেপথ্য কোনও ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ রয়েছে কি না বা আরও কেউ এতে জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে একটি অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দেবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। দ্বিতীয় চার্জশিট না আসা পর্যন্ত এক না একাধিকের বিতর্ক চলতেই থাকবে। যদি না দ্বিতীয় চার্জশিট পেশ করার আগে সিবিআই ওই বিষয়ে আদালতে কোনও আলোকপাত করে।
(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)