TMC Age Policy

অভিষেকের বয়স-মডেল প্রতিষ্ঠিত হলে বাদ পড়বেন অনেক মন্ত্রীই! ৬৫-ঊর্ধ্ব বিধায়কের সংখ্যাও প্রচুর

জেলাওয়াড়ি তৃণমূল বিধায়কদের বয়সের রেখচিত্র আঁকলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি ধরা পড়ছে ঝাড়গ্রামের ক্ষেত্রে। জঙ্গলমহলের এই জেলার ১০০ শতাংশ বিধায়কেরই বয়স চল্লিশের ঘরে। আজ শেষ কিস্তি।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:০০
Share:

তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

তৃণমূলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স-মডেল কার্যকর হলে অন্তত ১০ জন সাংসদ তো টিকিট পাবেনই না, তথ্য-পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ২০২৬ সালে বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে অন্তত ৮৮ জন বিধায়ককে বদলে দিতে হবে! যাঁদের মধ্যে ৭৬ জনের বয়স এখনই ৬৫ অথবা তার বেশি। আর সময়ে বিধানসভা ভোট হলে অর্থাৎ ২০২৬ সালে আরও ১২ জন সেই তালিকায় যুক্ত হবেন।

Advertisement

শুধু কি বিধায়ক? রাজ্য মন্ত্রিসভার ১৪ জন সদস্যকেও বাদ পড়তে হবে বয়স-নীতিতে। তবে এই তালিকায় মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাখা হচ্ছে না। অভিষেকের প্রণীত বয়স-মডেলের পক্ষে অন্যতম সওয়ালকারী কুণাল ঘোষ বলেই দিয়েছেন, এই ধরনের কোনও মানদণ্ডে মমতাকে ফেলা হবে না। কারণ ‘দিদি ব্যতিক্রম’।

সেই সূত্রে বলা ভাল, একমাত্র দিদিই ব্যতিক্রম। মমতাকে বাদ দিলে ওই ১৩ জন মন্ত্রী কারা, যাঁদের বয়স এখনই ৬৫ বা তার বেশি? তালিকায় রয়েছেন উদয়ন গুহ (৬৮), বিপ্লব মিত্র (৭১), উজ্জ্বল বিশ্বাস (৬৯), এখন জেলবন্দি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (৬৫), শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় (৭৯), চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (৬৮), বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা (৭৪), জাভেদ আহমেদ খান (৬৭), অরূপ রায় (৬৭), বিপ্লব রায়চৌধুরী (৭৪), মানস ভুঁইঞা (৭১), সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী (৭৪), প্রদীপ মদুমদার (৭৪) এবং মলয় ঘটক (৬৭)।

Advertisement

রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের এখন ৬৪ বছর চলছে। ২০২৬ সালে তিনিও ৬৫ পার করে ফেলবেন। তিনি অবশ্য এই বয়সনীতিকে সমর্থন করেন না। তিনি মনে করেন, ‘‘মানুষ যাঁদের চাইবেন, তাঁদেরই টিকিট পাওয়া উচিত।’’ তবে বয়সবিধিতে পড়বেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিমানের এখন ৭৪ চলছে। আশিস ৭২। বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষ এবং উপ মুখ্যসচেতককেও তাপস রায়কেও বয়সবিধিতে পড়তে হবে। দু’জনে এখনই ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে।

এই মুহূর্তে তৃণমূলের চার বিধায়ক নানা মামলায় জেলবন্দি। তাঁর মধ্যে জ্যোতিপ্রিয় তথা বালু এখনও মন্ত্রী। তাঁর বয়সের বিষয়টি আগেই উল্লিখিত। বাকি তিন জনের মধ্যে বড়ঞার জীবনকৃষ্ণ সাহা বাদ দিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মানিক ভট্টাচার্যের বয়স ৬৫ পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, জেলবন্দি চার বিধায়কের তিন জনই ৬৫-ঊর্ধ্ব। ফলে আগামী বিধানসভার আগে তাঁরা নির্দোষ হয়ে মুক্ত হলেও বয়সবিধি কার্যকর হলে তাঁদের টিকিট পাওয়া মুশকিল! উল্লেখ্য, জেলবন্দি অবস্থায় ভোটে লড়ার ইতিহাসও রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে তা হয়েছিল মদন মিত্রের ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে সারদা মামলায় জেলবন্দি মদন ভোটে লড়েছিলেন কামারহাটি থেকে। কিন্তু তিনি হেরে যান। ২০২১ সালে ফের সেখান থেকেই জেতেন ‘মুক্ত’ মদন। তাঁর বয়স এখন ৬৯ বছর। আপাতত তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

তৃণমূলের বিধায়কদের মধ্যে এখন ‘প্রবীণতম’ মালদহের রতুয়ার সমর মুখোপাধ্যায়। তাঁর বয়স ৮০ বছর। অভিষেক-কথিত বয়সনীতি প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনকে সমর বলেন, ‘‘আমাদের উপর দলের নির্দেশ রয়েছে, এই সমস্ত ব্যাপারে যা বলার দলের মুখপাত্রেরা বলবেন। তাই আমার কিছু বলার নেই। দলের সিদ্ধান্তই আমার কাছে শিরোধার্য।’’ একই সুরে দলের ‘বাধ্য’ থাকার কথা বলছেন মন্ত্রিত্ব খোয়ানো মেখলিগঞ্জের বিধায়ক পরেশ অধিকারী। তবে রাজ্যের মন্ত্রী তথা দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরের বিধায়ক বিপ্লব মিত্র আবার অভিষেকের বয়সনীতি প্রসঙ্গে মমতার কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘‘আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই দিয়েছেন, বয়স কোনও বিষয় নয়। মনের বয়সটাই আসল।’’ বিপ্লব বলতে চেয়েছেন ২৩ নভেম্বর ছিল নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশনের মঞ্চ থেকে মমতার বক্তব্যের কথা। যেখানে সৌগত রায়ের নামোল্লেখ করে তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী বলেছিলেন, ‘‘বয়স আবার কী! মনের বয়সটাই আসল কথা।’’ তবে সদ্য মন্ত্রিত্ব খোয়ানো তমলুকের বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্র ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। সদ্য স্বামীহারা হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মালদহের মানিকচকের বিধায়ক সাবিত্রী মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘আমার ৬২ চলছে। যদি ৬৫ ঊর্ধ্বসীমা হয়, তা হলে তো অনেককেই ছাড়তে হবে! আর কে বলেছে সারা জীবন রাজনীতি করতে হবে? এ বার তো পরিবার, নাতি-নাতনিদেরও সময় দিতে হবে।’’ সাবিত্রীর কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, তিনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত।

জেলাওয়াড়ি তৃণমূল বিধায়কদের বয়সের রেখচিত্র আঁকলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি ধরা পড়ছে ঝাড়গ্রামের ক্ষেত্রে। জঙ্গলমহলের ওই জেলার ১০০ শতাংশ বিধায়কেরই বয়স ৪০-এর ঘরে। এই ছবি আর কোনও জেলায় নেই। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম লোকসভা হারিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভায় জেলার চারটি আসনেই জয় পায় জোড়াফুল শিবির। ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর এবং বিনপুরে বিধায়ক হন যথাক্রমে বীরবাহা হাঁসদা (৪১), দুলাল মুর্মু (৪৭), খগেন্দ্রনাথ মাহাত (৪১) এবং দেবনাথ হাঁসদা (৪০)।

এ কথা ঠিক যে, ২০২১ সালের ভোটে বহু আসনে প্রার্থী বদল করেছিল তৃণমূল। তবে সেই প্রার্থী বাছাইয়ে অনেক মানদণ্ড দেখা হলেও বয়স কোনও ‘সূচক’ ছিল না। কিন্তু ২০২৬ সালে যদি তৃণমূল বয়সনীতি বাস্তবায়িত করে এবং ৬৫ বছর যদি ঊর্ধ্বসীমা হয়, তা হলে স্রেফ বয়সের কারণেই প্রায় ৯০টি আসনে প্রার্থী বদল করতে হবে। তাতে কোপ পড়বে অনেক বড় নেতার উপরেও। সেই পথে কি এগোবেন অভিষেক?

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীতালিকা তারও ইঙ্গিত দেবে। (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement