তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
বর্ধমান পূর্বের সাংসদ সুনীল মণ্ডল বলছেন, ‘‘অধিকাংশ সাংসদেরই বয়স ৬৫ বা তার বেশি। কারণ, সংসদে অভিজ্ঞতার একটা বিষয় থাকে। তবে দল যদি ৬৫ বছরকে ঊর্ধ্বসীমা ধরে, তা হলে আমাদের সেটাই মানতে হবে। দলের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।’’
জয়নগরের সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল এখন ৫৭। তিনি অবশ্য তৃণমূলে প্রস্তাবিত (এবং বিতর্কিত) বয়ঃসীমার বন্ধনীতে এখনই পড়ছেন না। তবু তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজনীতিতে বয়স কখনওই ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় না। তবে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত।’’
পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংসদের বক্তব্য, ‘‘রাজনীতিতে পরিণতিবোধ তৈরি হয় পঞ্চাশের পরে। সেখানে কাউকে পঁয়ষট্টিতে থামিয়ে দেওয়া হলে সেই ভাবনা অবাস্তব ছাড়া কিছু নয়।’’ দলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে ওই সাংসদের মন্তব্য, ‘‘আমরা নবীন বয়সে সিপিএমের মার খেয়েছি, মমতাদির সঙ্গে লড়াই করেছি। কখনও ভাবিইনি ভোটে দাঁড়াব এবং জিতব। এখনকার নবীনেরা তো আসছেই ক্ষমতা দেখে। সাংসদ-বিধায়ক হতে।’’
কয়েক মাস আগে রাজ্যসভার প্রার্থী তালিকায় ‘অন্য দিশা’ দেখিয়েছিল তৃণমূল। তথাকথিত তারকাদের টিকিট না দিয়ে সামিরুল ইসলাম, প্রকাশ চিক বরাইকদের সংসদের উচ্চকক্ষে পাঠানোর শাসকদলের সিদ্ধান্তে অনেকেই ‘অভিষেক মডেল’ দেখতে পেয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় এসে যখন তৃণমূলে বয়সনীতি নিয়ে মন্থন শুরু হয়েছে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে প্রার্থীতালিকা নিয়ে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টই বলেছেন, তিনি মনে করেন অন্য চাকরি, ফুটবল, ক্রিকেটের মতো রাজনীতিতেও অবসরের একটা বয়স থাকা উচিত। সেই বয়স কত? অভিষেকের মতে, তা ৬৫-র বেশি হওয়া উচিত নয়।
এই বয়সনীতি দলে বাস্তবায়িত হলে লোকসভা ভোটে কারা টিকিট পাবেন, কাদের অবসরে যেতে হবে?
খাতায় কলমে এখন তৃণমূলের লোকসভার সাংসদ ২৩ জন। শিশির অধিকারী, দিব্যেন্দু অধিকারীকে ধরে এবং অর্জুন সিংকে বাদ দিয়েই ২৩। কারণ শিশির, দিব্যেন্দু ২০১৯-এর ভোটে জিতেছিলেন তৃণমূলের প্রতীকে। অর্জুন ব্যারাকপুরে জিতেছিলেন পদ্মফুল চিহ্নে। তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এই ২৩ জনের মধ্যে ১০ জনের বয়স ৬৫ বা তার বেশি। সেই তালিকায় রয়েছেন কাঁথির শিশির (৮২), হাওড়া সদরের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৮), শ্রীরামপুরের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৭), দমদমের সৌগত রায় (৭৭), মথুরাপুরের চৌধুরীমোহন জাটুয়া (৮৫), বোলপুরের সাংসদ অসিত মাল (৬৮), আসানসোলের শত্রুঘ্ন সিংহ (৭৭), বর্ধমান পূর্বের সুনীল মণ্ডল (৬৫), কলকাতা উত্তরের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (৭১) এবং কলকাতা দক্ষিণের মালা রায় (৬৬)। বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার গত নভেম্বরে ৬৪ বছর পূর্ণ করেছেন। তাঁর আপাতত ৬৫ চলছে।
এই তালিকায় অবশ্য এমন অনেক নাম রয়েছে, যাঁদের বয়স ছাড়াও বাদ যাওয়ার অন্য মানদণ্ড রয়েছে। যেমন শিশিরের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান যা, তাতে তাঁর বয়স যদি এখন ৬০-ও হত তা হলেও তাঁকে তৃণমূল টিকিট দিত না। ফলে কয়েক জন এমনিই বাদ পড়বেন। বর্ধমান পূর্বের সাংসদ ৬৫ বছরের সুনীল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেই অমিত শাহের মঞ্চে গিয়ে বিজেপিতে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ‘ভুল বুঝতে পেরে’ সুনীলের তৃণমূল-ওয়াপসি হয়েছে। তাঁকেও ২০২৪-এর ভোটে তৃণমূল টিকিট দেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রবীণ সাংসদ জাটুয়ার শারীরিক অসুস্থতা গুরুতর। তিনি কার্যত রাজনীতির বৃত্তেই নেই। কিন্তু বাকিরা? ৬৫ ঊর্ধ্বসীমা কার্যকর হলে কল্যাণ, সুদীপ, সৌগত, অসিত, প্রসূন, মালা, শত্রুঘ্নদের টিকিট পাওয়া মুশকিল হওয়া উচিত।
গত লোকসভা ভোটে বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনে একা লড়েছিল তৃণমূল। জিতেছিল ২২টিতে। পরে উপনির্বাচনে আসানসোল আসন হাতে আসে জোড়াফুল শিবিরের। দু’টি আসনে কংগ্রেস জিতেছিল। বিজেপি ১৮টিতে জিতলেও আসানসোল হারিয়ে এখন তাদের হাতে ১৭টি (অর্জুনকে ধরে) আসন। যে যে আসনে তৃণমূল গত বার হেরেছিল, সেগুলিতে তারা এ বার নতুন প্রার্থী দিতে পারে বলে অনেকের ধারণা। একই সঙ্গে যদি বয়সের কারণে ১০ জনকে বাদ পড়তে হয়, তা হলে ৪২টির মধ্যে ২৯টি আসনে নতুন মুখ দিতেই হবে। তা কি আদৌ সম্ভব? সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে দলের মধ্যে। কেউ বলছেন নতুন কিছু করতে গেলে বাধা আসে, আবার কেউ বলছেন এ সব ‘ইউটোপিয়ান’ ধারণা।
প্রসঙ্গত, গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থীতালিকায় একটা মিশ্র অভিমুখ দেখিয়েছিল। তাতে তারকা, তরুণ, প্রবীণ, মহিলা, অনগ্রসর শ্রেণি— সব অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল। জেতা-হারার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল কোথাও তারকারা হেরেছেন, কোথাও জিতেছেন। তরুণ, মহিলা, প্রবীণ— সব ক্ষেত্রেই জেতা-হারা দুই-ই ছিল। ফলে সরল ভাবে এটা বলে দেওয়া যায় না যে, বয়স বা নির্দিষ্ট কারণে জেতা-হারা নির্ণিত হয়েছিল। বরং ফলাফল নিয়ে শাসদকদলের অন্দরে যে ময়নাতদন্ত হয়েছিল তার নির্যাস ছিল এই যে, হারা জায়গায় নিচুতলায় সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল বিস্তর। তা ছাড়া, সরকারি প্রকল্প মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পঞ্চায়েত স্তরে বড়সড় ফাঁক থেকে গিয়েছিল।
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে গত বার তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ মুখ তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা। তিনি হেরেছিলেন। পাশের বাঁকুড়া আসনে পরাস্ত হতে হয়েছিল প্রবীণ নেতা অধুনাপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়কেও। তারকা মুখ মুনমুন সেন পরাজিত হয়েছিলেন আসানসোলে। সে বার মুনমুনকে বাঁকুড়ার জেতা আসন থেকে এনে আসানসোলে প্রার্থী করেছিলেন মমতা। আবার বালুরঘাটে পরাস্ত হন নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ। ২০১৪ থেকে অর্পিতা ছিলেন সেখানকার সাংসদ। অন্য দিকে দেব, মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহানেরা জয় পেয়েছিলেন।
অনেকের মতে, বয়সবিধি নিয়ে মমতা এবং অভিষেকের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। দু’জনের সাংগঠনিক কাজের ধারাও ভিন্ন। যে কারণে দুই শিবিরের দ্বন্দ্বও স্পষ্ট। ইদানীং অভিষেক যে কর্পোরেট ধাঁচে সংগঠন পরিচালনা করেন, তা মমতার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ২০১৯-এর লোকসভায় তৃণমূল ধাক্কা খাওয়ার পর প্রশান্ত কিশোর এবং আইপ্যাককে সংগঠনে ও প্রশাসনে যুক্ত করেছিল তৃণমূল। তার নেপথ্যে অভিষেক ছিলেন বলেই দলশ্রুতি। তার ফল মিলেছিল ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে। তার পরে প্রশান্ত আইপ্যাক ছাড়লেও সংস্থাটি তৃণমূলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। তৃণমূলের অনেক প্রবীণ নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘‘আমাদের ভাগ্য তো এখন বেসরকারি সংস্থার হাতে।’’ সেই সংস্থা যদি অভিষেকের ‘মানদণ্ড’ অনুযায়ী প্রার্থী বাছাইয়ে মন দেয়, তা হলে লোকসভায় নতুন তৃণমূল দেখা যাবে। এমনও হতে পারে যে, লোকসভার আর বেশি দেরি নেই বলে প্রার্থী নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাওয়া হল না। কিন্তু ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট? সেখানে কি অভিষেক-নির্ধারিত বয়ঃসীমা প্রযোজ্য হবে? হলে কারা থাকবেন আর কারা বাদ পড়তে পারেন? (চলবে)