রাজ্যপালের প্রধান সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল নন্দিনী চক্রবর্তীকে। ফাইল চিত্র।
শনিবার সকালে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বৈঠকের পর থেকে রাজভবনের একের পর এক পদক্ষেপ রাজনৈতিক জল্পনা তৈরি করছে। সর্বশেষ পদক্ষেপ রাজ্যপালের প্রধান সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল নন্দিনী চক্রবর্তীকে। রাজভবন সূত্রে খবর, সোমবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে আনন্দের। তার আগের রাতেই নন্দিনীকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্যপাল নবান্নকে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজভবন বা নবান্নের তরফে এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
আনন্দ রাজভবনে আসার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে শাসক তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ওঠে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেন, এই ঘনিষ্ঠতার পিছনে নন্দিনীর ভূমিকা রয়েছে। এর পর থেকেই সরব হয় রাজ্য বিজেপি। গেরুয়া শিবির সূত্রে খবর, এই বিষয়ে খোঁজ নেয় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। রাজ্যপালের শপথ, সরস্বতী পুজোর দিনে ‘হাতেখড়ি’, সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের অনুষ্ঠান থেকে বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনে ভাষণ— এ সবই নিয়ে নানা অভিযোগ তোলে বিজেপি। মূলত সরব হন শুভেন্দু। প্রথম দিকে বিষয়টা নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চুপ থাকলেও পরে শুভেন্দুর অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এর পরে শনিবার রাজভবনে যান সুকান্ত। ঘণ্টা দু’য়েক বৈঠক কথা বলেন আনন্দের সঙ্গে। সুকান্ত রাজভবন থেকে বেরিয়ে যে মন্তব্য করেন তাতেই বোঝা গিয়েছিল, রাজভবনের মনোভাবে কিছু বদল এসেছে। এর পরে শনিবার সন্ধ্যাতেই রাজভবনের পক্ষে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে এবং রাজ্যপালের পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে কড়া বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় আনন্দ পথ বদলাচ্ছেন। নন্দিনীর অপসারণ তারই পরিনতি বলে মনে করা হচ্ছে।
জগদীপ ধনখড় রাজ্যপাল থাকার সময়ে তাঁর প্রধান সচিব পদে ছিলেন সুনীলকুমার গুপ্ত। ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হলে তিনিও দিল্লি চলে যান। উপরাষ্ট্রপতির প্রধান সচিব হন। এর পরে অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে লা গণেশন দায়িত্বে এলে তাঁর প্রধান সচিব হন আইএএস নন্দিনী। পরে আনন্দ এলেও তিনিই দায়িত্বে থাকেন। তবে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আলোচনা হতে শুরু করে গত দুর্গাপুজোর সময় থেকে। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পুজো হিসাবে পরিচিত রামমোহন সম্মিলনীতে নন্দিনীকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। রাজ্যপালের প্রধান সচিব ও কুণাল একসঙ্গে মঞ্চে রয়েছেন এমন ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবিকে হাতিয়ার করেই বিজেপি আক্রমণ শানাতে শুরু করে। সম্প্রতি রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানে বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসাবে সুকান্ত এবং বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দু আমন্ত্রণ পেলেও আর কাউকে ডাকা হয়নি। অন্য দিকে, তৃণমূলের অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও আমন্ত্রণ পেয়ে যান। এর পিছনেও নন্দিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ে শুভেন্দু একটি টুইটে লিখেছিলেন যে, নন্দিনী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজভবনকে ব্যবহার করছেন।
নন্দিনী ১৯৯৪ ব্যাচের আইএএস অফিসার। অতীতে রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ দফতের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠলেও অতীতে তাঁর সঙ্গে মমতার দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথাও শোনা যায়। যদিও ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে নন্দিনী মমতার ‘প্রিয়পাত্রী’ হয়ে ওঠেন বলে জানা যায়। তখন শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও তথ্য-সংস্কৃতি সচিবের মতো গুরুদায়িত্ব তিনি এক সঙ্গে সামলেছেন। পরে নাকি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে তাঁর গুরুত্ব কমতে থাকে। প্রথমে ওঁকে নিগম থেকে সরানো হয়। পরে তথ্য-সংস্কৃতিও কেড়ে নিয়ে পাঠানো হয় স্টেট গেজ়েটিয়ারের এডিটর পদে। সেখান থেকে সুন্দরবন উন্নয়ন। তার পর ফের প্রশাসনিক দিক থেকে প্রায় গুরুত্বহীন প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে। সেই নন্দিনী রাজভবনে যাওয়ার পরে ফের ‘শাসক দলের লোক’ তকমা পান। রাজভবন সূত্রে খবর, সেই তকমার কারণেই তাঁকে সরতে হল।
এখন প্রশ্ন, নন্দিনীকে সরানোর পরে কে হবেন রাজ্যপালের নতুন প্রধান সচিব? নিয়ম বলছে, রাজ্য সরকারের তরফে নতুন কোনও আইএএসকে নিয়োগ করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিজের অপছন্দ জানাতে পারেন। আবার আগে থেকেই নিজের পছন্দের কোনও নাম তিনি নবান্নকে জানাতে পারেন। তবে সবকিছুই নাকি নির্ভর করছে সোমবার শাহ-আনন্দ বৈঠকের পরে। তবে কখন সে বৈঠক তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি।