প্রতীকী চিত্র।
অসুস্থতা সত্ত্বেও বন্দিদশা ঘোচেনি মানবাধিকার কর্মী, জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামীর। শেষ পর্যন্ত সেখানেই তিনি মারা যান। `শহুরে মাওবাদী`-র তকমা পাওয়া স্ট্যানের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-তে (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট বা বেআইনি কার্যকলাপ বিরোধী আইন) মামলা রুজু হয়েছিল। সেই ঘটনায় দেশ জুড়ে হইচই হয়। আবার মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর দাবি, কলকাতার একটি জেলে ২০১৯ সালে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ না পেয়ে মৃত্যু হয়েছিল শিলদা মামলায় অভিযুক্ত মাওবাদী নেতা সুদীপ চোংদারেরও।
শিলদায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ক্যাম্পে ২০১০ সালে মাওবাদীদের হামলার ঘটনায় ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত, ১০ বছর ধরে বন্দি ধৃতিরঞ্জন মাহাতো এবং বুদ্ধদেব ওরফে বুদ্ধেশ্বর মাহাতোও অসুস্থ বলে জানিয়েছে পরিবার। দু’জনে বর্তমানে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে রয়েছেন। তাঁদের মামলা বকেয়া পড়ে রয়েছে মেদিনীপুরের ষষ্ঠ দায়রা বিচারকের এজলাসে। পরিবারের দাবি, বুদ্ধেশ্বরের দু`টি কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ধৃতিরঞ্জনের মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছে।
এপিডিআর জানাচ্ছে, সব মিলিয়ে ৭২ জন বন্দির মুক্তির দাবিতে তারা অনেক দিন ধরেই সরব। ৬৮ জন বিচারাধীন। ৬৪ জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা রয়েছে। যাঁদের মধ্যে ৫০ জন জঙ্গলমহলের বাসিন্দা। চার জন যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত, তবে তাঁদেরও জেলের ভিতরে ১৭ বছর কেটে গিয়েছে।
অনেক আইনজীবী এবং প্রাক্তন বিচারকের মতে, ইউএপিএ-সহ বিভিন্ন গুরুতর মামলায় জামিন পাওয়া এমনিতেই কঠিন। ওই সব আইনে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থাকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে দেওয়া রয়েছে, ফলে জামিনের বিরোধিতা করা সোজা। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদনের সুযোগ থাকলেও বহু ক্ষেত্রে অর্থের অভাবে অনেকেই তা করতে পারেন না। আবার তদন্তকারী সংস্থাও অনেক সময় ‘জোরালো প্রমাণের অভাবে শুনানি পিছনোর’ চেষ্টা করে বলেই অভিযোগ।
জ্ঞানেশ্বরী এবং শিলদার ঘটনায় বিচারাধীন কয়েক জন বন্দির জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে লড়ছেন আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত। ধৃতিরঞ্জন এবং বুদ্ধেশ্বর—দু’জনের মামলাও দেখছেন তিনি। কৌশিকবাবু জানান, শিলদা মামলায় ১০ বছরে ২০০টি শুনানি হয়েছে। ৭০ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩৩ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আবার মেদিনীপুরের সেই আদালতে শিলদা মামলার আইনজীবী অজয় ঘোষ জানান, মামলা চলতে থাকার কারণ বহুবিধ। অনেক সময়ে অভিযুক্তকে সময় মতো জেল থেকে আদালতে হাজির করানো হয়নি। কখনও সাক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘‘এক বার সাক্ষী না পাওয়া গেলে শুনানির পরবর্তী দিন পেতে অনেকটা সময় লেগে যায়।’’
প্রায় একই সমস্যার কথা জানিয়েছেন শিলদা মামলারই সরকারি আইনজীবী দেবাশিস মাইতি। তিনি জানান, অতিমারির কারণে দীর্ঘ দু’বছর বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। ওই মামলার বিচারক অসুস্থ অনেক দিন। ভারপ্রাপ্ত এক বিচারক বর্তমানে রয়েছেন। আবার সাক্ষী তৈরি থাকলেও দূর-দূরান্তের জেল থেকে অভিযুক্তকে আদালতের সময়ে মতো হাজির করানো যায় না অনেক সময়ে। তিনি বলেন, ‘‘যাতায়াতের ধকল নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন বন্দিরাও। আমাদেরও খারাপ লাগে।’’ আদালত সূত্রে খবর, বিচারকের কাছে আবেদন করা হয়েছে, যাতে মামলা চলাকালীন সময়ে বন্দিদের স্থানীয় জেলে রাখার অনুমতি পাওয়া যায়।’’
বিচারাধীন বন্দিরা এ ভাবে আটকে থাকলেও রাজ্য সরকারের এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই বলেই দাবি আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের। তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিকই, বহু মানুষ বিচার শেষ না হওয়ায় আটকে রয়েছেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি হাই কোর্টের উপরে নির্ভর করে। বিচার দ্রুত শেষ করতে এ রাজ্যে সরকার এখনও নিজেদের খরচে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা হাই কোর্টের সঙ্গে কথাও বলি নিয়মিত।’’
যদিও সরকার চাইলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে পারে বলেই দাবি এপিডিআর-এর। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রঞ্জিত শূরের দাবি, ‘‘আইপিসিতে সেই ধারা রয়েছে। ইউএপিএ ধারায় মামলা হওয়া সত্ত্বেও বিমল গুরুং তো গ্রেফতারই হননি। বিচারের নামে প্রহসন করে অসহায় গরিব মানুষদের আটকে রাখা হয়েছে। সরকার চাইলে এঁদের মুক্তি দিতে পারে।’’ আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘ইউএপিএ ধারায় মামলা সত্ত্বেও অনেক প্রভাবশালী রাজনীতির অলিন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওই ধারায় মামলা হলেও জামিন, দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি যে কোনও বন্দির মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। যদি বিচার শেষ না করে অভিযুক্তকে জেলবন্দি করে রাখা হয়, সেই অধিকার লঙ্ঘিত হবে।’’ আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতাও বলেন, ‘‘যে কোনও ধরনের মামলাতেই হাজতে থাকা অভিযুক্তের দ্রুত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কোনও যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে বিচারে বিলম্ব করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল।’’
কিন্তু সমাধান কোথায়? বিচারের বাণী শোনার আশায় অপেক্ষা যে ফুরোয় না।
তথ্য সহায়তা: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়