নাকের ডগায়: বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাতের অংশ দখল করে অবৈধ পার্কিংয়ের ব্যবসা। হাওড়ার নাজিরগঞ্জে, একটি বেসরকারি হাসপাতালের কাছে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ঠিকানা: ৩১, বিপ্রদাস চ্যাটার্জি লেন। হাওড়া পুরসভার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। জায়গার নাম ঘোষবাগান মাঠ। আগে ছিল খেলার মাঠ। কচিকাঁচাদের ক্রিকেট-ফুটবলে জমজমাট থাকত চার-পাঁচ কাঠার এই ক্রীড়াঙ্গন। বছর তিনেক আগে মাঠটি ত্রিপল দিয়ে ঘিরে প্রথমে একটি গোয়ালঘর তৈরি করা হল। মাস কয়েক আগে ওই খেলার মাঠের চার দিকে তোলা হল পাঁচিল। তার পরে গেট বসিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল তালা। পুরো মাঠটাই বেদখল হয়ে গেল এলাকার বাসিন্দাদের চোখের সামনে।
ঠিকানা: হাঁসখালি পোলের ডান দিকে চাঁদমারি রোডের মাঠ। ওয়ার্ড নম্বর ৪৫। সরকারি জমি। এক কালে ছিল ফাঁকা। বর্তমানে কয়েক বিঘার সেই সরকারি জমির উপরেও গজিয়ে উঠেছে একের পর এক আবাসন। একই চিত্র নাজিরগঞ্জ ও বটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন গঙ্গাতীরবর্তী এলাকায়। সরকারি জমি দখল করে সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক বহুতল আবাসন। যার না আছে কোনও সরকারি অনুমোদন, না আছে পুরসভার অনুমোদিত নকশা।
ঠিকানা: নাজিরগঞ্জ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা। সেখানে কয়েক বিঘা সরকারি জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে পার্কিং লট। ওই নির্মাণের না আছে কোনও সরকারি অনুমোদন, না আছে পার্কিং করে টাকা তোলার অধিকার। সেই পার্কিং লটে দু’চাকার গাড়ি রাখার জন্য কখনও নেওয়া হয় পাঁচ টাকা, কখনও আবার ১০ টাকা। চার চাকার গাড়ির জন্য কখনও ৩০ টাকা, তো কখনও আবার ৫০ টাকা। না দিতে চাইলেই জুটছে পাহারাদার যুবকদের চোখরাঙানি।
উপরের তিনটি চিত্রই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বর্তমানে হাওড়া শহর জুড়ে আইনের শাসনের কী হাল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জমি দখল করে বেআইনি কারবার চালানোর পিছনে মূল মাথা হিসেবে উঠে এসেছে এলাকার ‘বড়দা’, ‘সিংহদা’ বা ‘খানদা’র নাম। নিজেরা আড়ালে থেকে কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেন এঁরা। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, মারধর বা প্রয়োজনে খুন করে ‘তোলাবাজি’র রমরমা কারবার চালাচ্ছেন তাঁরা। যার মাসুল গুনতে হচ্ছে নিরীহ বাসিন্দাদের।
কিন্তু এলাকায় পুলিশ-প্রশাসন থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে চলছে এই দাদাগিরি?
নাজিরগঞ্জ এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, ‘‘এই সমস্ত জোরজুলুমের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষ মদত। তাঁরাই তো দুষ্কৃতীদের কাজে লাগিয়ে জায়গা দখল করছেন। তার পরে প্রোমোটারদের থেকে প্রতি বর্গফুট হিসেবে মোটা টাকা তুলে পুলিশ ও নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছেন। এই সুযোগে একের পর এক অবৈধ নির্মাণ করে নিজেদের পকেট ভরছেন অসাধু কিছু প্রোমোটার।’’
এলাকার বাসিন্দারা অবশ্য সব জেনেও ভয়ে মুখ খোলেন না। যাঁরা কথা বলতে রাজি হন, তাঁরা নিজেদের পরিচয় গোপন করেন। যেমন, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের পোদরার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘আমার এক বন্ধু নাজিরগঞ্জের একটি ইটভাটার পাশে কয়েক বিঘা জমি কিনেছিল বছরখানেক আগে। কিন্তু এক রাতে পুলিশ এসে গোটা জমি টিন দিয়ে ঘিরে দেয়। পরে দেখা যায়, সেই জমি দখল হয়ে গিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, ‘উপরওয়ালা’র নির্দেশ। কিচ্ছু করার নেই। সেই জমি ও আজও ফেরত পায়নি। সেখানে এখন বড় বাড়ি উঠছে।’’
হাওড়ার বাসিন্দাদের মতে, স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা, পুলিশকর্মীদের একাংশ এবং দুষ্কৃতীদের গোপন আঁতাঁতের জেরেই অপরাধের মাত্রা এতটা লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক ডামাডোলের এই বাজারে দুষ্কৃতীদের ঠেকানোরও কেউ নেই। আর এই সুযোগটাই যতটা সম্ভব কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। দিন দিন বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, খুন, জখম।
হাওড়া সিটি পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ মানতে রাজি নয়। পুলিশের এক কর্তা বললেন, ‘‘এলাকার দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যেই ‘শিবপুর’কে অপরাধের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাস্তায় সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। বাসিন্দাদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দু’-একটি বিক্ষিপ্ত অপরাধের ঘটনা ঘটছে ঠিকই, কিন্তু হাওড়া শহর দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, এমন অভিযোগ ঠিক নয়।’’
তা হলে শহরের মানুষ এতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কেন? সে উত্তর অবশ্য পুলিশকর্তারা দিতে পারেননি।