(বাঁ দিক থেকে) তপন সিকদার, বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত, পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কলকাতা, নিউটাউন, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহারের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা পুরসভার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের বাড়ি। পাটুলি, নাকতলা-সহ সংলগ্ন এলাকায় গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর ‘দাপট’ সর্বজনবিদিত। সাম্প্রতিক কালে সকলেই তাঁকে জানতেন প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন’ হিসেবে। কী ভাবে এই রাজনৈতিক উত্থান হল তাঁর?
২০০৬ সালে যখন পার্থ রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হন, তখন থেকেই এই ওজনদার নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাপ্পাদিত্যের। ২০১৫ সালে ‘বিশ্বস্ত’ বাপ্পাকে পুরভোটে টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল। দলশ্রুতি: পার্থই সেই টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তার পর থেকে পর পর দু’বারের কাউন্সিলর বাপ্পা। এর মধ্যে গত পুরভোটের সময়ে প্রার্থী কারা হবেন, তা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে বিস্তর ‘মতানৈক্য’ হয়েছিল। শীর্ষ নেতৃত্বের সেই মতানৈক্যের কথা চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকেনি। তখনই জানা গিয়েছিল, ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপ্পার নাম প্রথম তালিকায় ছিল না। পরে পার্থের সুপারিশেই তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, কালীঘাটে মিলন সঙ্ঘের মাঠে সাংবাদিক সম্মেলনের পর পার্থ নিজেই বাপ্পাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘তোরটা করে দিয়েছি!’’ যদিও এর কোনও আনুষ্ঠানিক সত্যতা কোনও তরফেই কখনও স্বীকার করা হয়নি। তবে বাপ্পা যে পার্থের ‘আস্থাভাজন এবং ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন, তা সর্বজনবিদিত।
অধুনা ৫০ বাপ্পা একটা সময়ে বিদ্যুৎ দফতরের কোনও এক বিভাগে কর্মরত ছিলেন বলে শোনা যায়। তবে শেষ তিনি কবে কর্মক্ষেত্রে গিয়েছেন, তা দলের কেউ বলতে পারছেন না। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তাঁর পরিচয় থেকেছে, তিনি ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ এবং তৃণমূল কাউন্সিলর। পাটুলি উপনগরীর জে ব্লকে বাপ্পা থাকেন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে।
কিন্তু পার্থের আগেও ‘রাজনৈতিক যোগ’ ছিল বাপ্পার। এবং তা একেবারেই বিপরীত মেরুর যোগ। একটা সময়ে তিনি ছিলেন অধুনাপ্রয়াত বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তপন সিকদারের ঘনিষ্ঠ। কার্যত তপনের সচিবের মতোই কাজ করতেন তিনি। বস্তুত, পার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার আগে পর্যন্ত এলাকার লোকজন তাঁকে ‘বিজেপি বাপ্পা’ বলেই চিনতেন। কারণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের কথায়, সেই সময়ে বিজেপি করার লোক ছিল হাতেগোনা। ফলে যাঁরা বিজেপি করতেন, তাঁদের এলাকায় সেই মর্মে পরিচিতি পেতে বিশেষ আয়াস করতে হত না। স্থানীয়দের অনেকের বক্তব্য, বাপ্পার বাবা মানিক দাশগুপ্ত ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ‘কাছের মানুষ’। তবে বাপ্পার পারিবারিক সূত্রে তেমন কিছু কখনও ঘটনা করে জানানো হয়নি। এলাকার লোকেরা জানেন যে, বাপ্পার বাবার একটি সিলিং ফ্যানের কারখানা ছিল।
২০০৪ সালে তপন হেরে যান দমদম লোকসভা কেন্দ্রে। তখন থেকে তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকেন। তার দু’বছর পরে ২০০৬ সালে তৃণমূলের বিধায়ক পার্থ হন বিরোধী দলনেতা। সেই ‘সন্ধিক্ষণে’ বাপ্পা পার্থের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। ‘বিজেপির বাপ্পা’ থেকে হয়ে উঠতে থাকেন ‘তৃণমূলের বাপ্পা’। দলীয় সূত্রের খবর, যে হেতু বাপ্পা দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলের ভাল ছাত্র ছিলেন, তাই গোড়ার দিকে পার্থ তাঁকে নানা বিষয়ে লেখালেখির খসড়া করার কাজে ব্যবহার করতেন। তা করতে করতেই ক্রমশ পার্থের ‘আস্থাভাজন’ হয়ে ওঠেন তিনি।
পাশাপাশি ছিল নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজো। যে পুজোয় পার্থ-বাপ্পার ‘জুটি’ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও নানা সময়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পরে আবার এই বাপ্পাই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন পার্থ-অর্পিতার ঘনিষ্ঠতা, ফ্ল্যাটে কোটি কোটি টাকা নগদ রেখে দেওয়ার তিনি কিছুই জানতেন না। যদিও জনশ্রুতি, অর্পিতার সঙ্গে পার্থের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ‘কান্ডারি’ ছিলেন বাপ্পাদিত্যই। তবে তিনি তা কখনওই সর্বসমক্ষে জানাননি। এর আনুষ্ঠানিক সত্যতাও কোনও তরফেই কখনও স্বীকার করা হয়নি।
তৃণমূলে বাপ্পার সতীর্থদের বক্তব্য, এই কাউন্সিলরের উত্থানের নেপথ্যে তিনটি বিষয় কাজ করেছিল। এক, তিনি পার্থের কাছের লোক। দুই, তিনি শাসক তৃণমূলের কাউন্সিলর। এবং তিন, কলকাতার অন্যতম বড় পুজো নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের অন্যতম কর্তা। যে পুজোর সুবাদে বাপ্পার সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ীরও ‘দহরম মহরম’ ছিল বলে জনশ্রুতি। শাসকদলের এক নেতার কথায়, ‘‘প্রশাসনিক ক্ষমতা, প্রভাবশালীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং অর্থ—এই তিনের সমীকরণে বাপ্পা ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল।’’ প্রভাবশালী এই কাউন্সিলরের সঙ্গে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরও সুসম্পর্ক রয়েছে বলে শোনা যায়।
ঘটনাক্রম বলছে, ২০২২ সালের ২৩ জুলাই সকালে পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বাপ্পা কিছুটা ‘গুটিয়ে’ গিয়েছিলেন। আগে যে প্রতাপ তাঁর দেখা যেত, ইদানীং তা কিছুটা স্তিমিত। সেই বাপ্পার বাড়িতেই হানা দিয়েছিল সিবিআই। পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরে সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা বেরিয়েছেন। তার পরে বাপ্পা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সিবিআই তাঁর থেকে কী কী নথি চেয়েছে এবং পেয়েছে।
কাউন্সিলর হিসেবে দক্ষিণ কলকাতায় বাপ্পার ‘নাম’ রয়েছে। চমক-দেওয়া সৌন্দর্যায়ন থেকে নানাবিধ অনুষ্ঠানে তাক লাগানো কর্মসূচি করে গিয়েছেন বাপ্পা। যা নিয়ে ঘনিষ্ঠমহলে পার্থ নিজের শ্লাঘার কথাও শোনাতেন। তবে তৃণমূলের এক নেতার বক্তব্য, প্রথম মেয়াদে কাউন্সিলর থাকার সময়ে বাপ্পার বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ দলের কাছে এসেছিল। চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে বাপ্পাকে নোটিসও পাঠিয়েছিল ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)। এ সব বিবিধ কারণে গত পুরসভা ভোটের প্রথম তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। পরে পার্থের সুপারিশেই তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়। তখনও পার্থ দলের মহাসচিব। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও বটে। পার্থ আপাতত জেলে বন্দি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বাপ্পার বাড়িতে তল্লাশি করল সিবিআই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সিবিআই টিম বাপ্পার বাড়ি ছাড়ে। পার্থের বিষয়ে কি তাঁকে কোনও প্রশ্ন করেছিলেন সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা? শান্ত ভাবে বাপ্পার জবাব, ‘‘কিছু কিছু ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে সে বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’’ তবে বাপ্পা এ-ও জানিয়েছেন, তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা তাঁকে জানিয়ে গিয়েছেন, তদন্তের প্রয়োজনে আবার তাঁর ‘সাহায্য’ নেওয়া হবে।