তিনি বিধাননগর পুরসভার দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর। অধুনা মেয়র পারিষদও। ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন বলে মনে করেন তাঁরই দলের একাংশ।
যদিও কেউ কেউ ভাবেন, তৃণমূল কাউন্সিলর দেবরাজ চক্রবর্তীর মাথায় হাত রেখেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর হাত ধরে তৃণমূলে দেবরাজ দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিলেন ।
তবে এ সব তো তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। গোটা বাংলা দেবরাজকে চেনে অন্য এক পরিচয়ে। বাংলার আমজনতার কাছে তিনি কীর্তনশিল্পী অদিতি মুন্সীর স্বামী।
মিষ্টি হাসি, লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো ছোটখাটো চেহারার অদিতিকে বাংলা চিনেছে কীর্তনের সুরে। ২০১৮ সালে সেই অদিতির সঙ্গে দেবরাজের বিয়ে হয়।
প্রচারের আড়ালে থেকে দলের সংগঠনের মেরুদণ্ড শক্ত করায় বিশ্বাসী দেবরাজের নাম আজ জানে বাঙালি। অদিতি আগেই পৌঁছে গিয়েছেন বাংলার ঘরে ঘরে। তাঁর স্বর মন ছুঁয়েছে আপামর বাঙালির।
মঞ্চে উঠলে ঈশ্বর ভজনে মগ্ন অদিতির গানে দোল খায় রাশি রাশি মাথা। উদ্বাহু হয়ে নাচেন মানুষ। কারও বা গাল বেয়ে নামে ধারা।
দেবরাজ কে? এই প্রশ্নই বাংলার সাধারণ মানুষ প্রথম জানতে চেয়েছিল অদিতির সঙ্গে বিয়ের খবর প্রকাশ্যে আসার পর। তার পর যদিও তাঁর কাজের কথা জেনেছেন আগ্রহীরা।
জেনেছেন, আড়ালে থাকলেও দেবরাজ আসলে রাজ্যের শাসকদলের এক জন ‘দাপুটে’ নেতা। রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিতে জেলও খাটতে হয়েছে তাঁকে।
যুব তৃণমূলের নেতা হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতিও ছিলেন। পরে রাজারহাট-গোপালপুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দুর আপ্তসহায়ক হিসাবেও কাজ করেন।
তৎকালীন মন্ত্রী পূর্ণেন্দুকে জেঠু বলে ডাকতেন দেবরাজ। সেই পূর্ণেন্দুর কাছেই ২০১৩ সালে বিধাননগর পুরসভার উপনির্বাচনের টিকিটের দরবার করেছিলেন, পাননি। ২০১৫ সালেও তাঁর একই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু।
বিধাননগরে ভোটে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে তৎকালীন মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু ও তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেনের সঙ্গে চরমে উঠেছিল দেবরাজের বিবাদ। শোনা গিয়েছিল, সেই বিবাদের জেরেই তৃণমূলের টিকিট পাননি তিনি।
এর পরে তৃণমূল ছাড়ার সিদ্ধান্ত। ২০১৫ সালে কংগ্রেসের হাত ধরেন দেবরাজ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর হাত থেকে দেবরাজ তুলে নেন কংগ্রেসের পতাকা। বিধাননগর পুরনিগম এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেসের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি।
যদিও সেই সিদ্ধান্তের জন্য খেসারতও কম দিতে হয়নি দেবরাজকে। ভোটের দিন তাঁকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে ছেড়ে দিয়ে আবার পরের দিন দক্ষিণ দমদমের এক তৃণমূল কাউন্সিলরকে মারধরের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় দেবরাজকে।
শোনা যায়, থানায় বসেই দেবরাজ এসএমএস পাঠিয়েছিলেন পূর্ণেন্দুকে— ‘জেঠু, আমি অ্যারেস্ট হলাম। ভুল কিছু করিনি। তা-ও হলাম। প্রেসকে সব বলব তোমার আর দোলাদির ব্যাপারে। এত নীচে নামবে আমি জানতাম না। থ্যাঙ্ক ইউ।’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলেননি দেবরাজ। তাঁর হয়ে বলেছিল তাঁর ভোটের ফল। ৩১২ নম্বর ভোটে জিতেছিলেন বিধাননগর পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। জামিনে মুক্ত হয়ে কংগ্রেসের কাউন্সিলর হিসাবে শপথ নেন।
তবে কয়েক মাসের মধ্যেই ‘হাত’ ছেড়ে ফের ঘরের ছেলে ফিরে আসেন ঘরে। তৃণমূলে ভবনে এসে তৃণমূলের তৎকালীন যুব সভাপতি অভিষেকের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘাসফুলের পতাকা হাতে তুলে নেন।
কয়েক মাসের মধ্যেই অভিষেকের ‘অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত হন দেবরাজ। ধীরে ধীরে রাজনীতির ময়দানে নিজের জায়গা পাকা করেন। বিধাননগর তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এক জন ‘দাপুটে’ নেতা হিসাবেও পরিচিত হন।
এর কিছু দিন পরেই ২০১৮ সালে অদিতির সঙ্গে বিয়ে। জ্যাংড়া এলাকার বাসিন্দা দেবরাজ। অদিতি থাকতেন বাগুইআটিতে। কাছাকাছি এলাকা। কিন্তু বিয়ের আগে দেখা হলেও সে ভাবে আলাপ হয়নি। বাড়ি থেকে দেখাশোনা করেই বিয়ে। এখন অবশ্য সেই অদিতি বিধায়ক।
গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অদিতিকে বিধায়ক পদের প্রার্থী হওয়ার টিকিট দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিতে রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্রের বিধায়ক হয়েছিলেন অদিতি।
ঘটনাচক্রে যে পূর্ণেন্দু এক সময়ে দেবরাজকে টিকিট দিতে চাননি, সেই পূর্ণেন্দুকেই সরিয়ে দেবরাজের স্ত্রীকে টিকিট দেয় তৃণমূল। নিন্দকেরা বলেন, দেবরাজই স্ত্রীর জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন দলের কাছে। কিন্তু নিন্দকদের মুখ কবেই বা বন্ধ করা গিয়েছে!
কাট টু ২০২৩-এর নভেম্বর মাসের শেষ দিনের সকাল। রাজারহাটের বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিলেন দেবরাজ। সাধারণ পোশাক। ৯টা ৪০ নাগাদ বাড়ির সামনে আসতেই চমক। তাঁকে রাস্তা থেকেই টেনে আনল সিবিআই। বাড়িতে তল্লাশি চালাল সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে।
অদিতি বাড়ি ছিলেন কি না জানা নেই। তাঁকে দেখা যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার সকালে অন্য দিনের মতো বিধানসভার করিডোরে শাড়ি পরা ছোটখাটো চেহারার লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো মেয়েটিকে মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। দল নিয়মিত আসার ফরমান জারি করেছে। সেই ফরমান না থাকলেও নিয়মিত বিধানসভায় আসেন রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক। বৃহস্পতিবার আসেননি।
আসবেনই বা কী করে? স্বামী দেবরাজের সঙ্গে দিনভর জুড়েছিল সিবিআই। তাঁর নিজের গানের স্টুডিয়োতেও তল্লাশি চালিয়েছে দেবরাজকে সঙ্গে নিয়ে। এই অবস্থায় কাজে যাওয়া কি সম্ভব!
সম্ভব নয়, কারণ স্টেজে যতই কীর্তনের সুরে তিনি শান্তি দিন শ্রোতাদের, তাঁর নিজের জীবনে সেই শান্তির সুরে বার বার মিলে যায় রাজনীতি। তবু কীর্তন আর রাজনীতির সুর মিলে তৈরি হয় অন্য রকম রোম্যান্স।