নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে মুর্শিদাবাদের তৃণমূল বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের বাড়িতে সিবিআই তল্লাশি ঘিরে জোর তরজা শুরু হয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, বিধায়কের বাড়ি থেকে ইতিমধ্যেই লাখ লাখ টাকা নগদ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। মিলেছে প্রচুর সোনার গয়নাও।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই জাফিকুলের বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে সিবিআই। তখন বাড়িতে ছিলেন না বিধায়ক। সিবিআই কর্তারা জাফিকুলের বাড়িতে ঢুকতেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বাড়ির গোটা চত্বর ঘিরে ফেলা হয়। এর পর দুপুর নাগাদ নিয়ে আসা হয় টাকা গোনার যন্ত্র। তার পরেই সিবিআই সূত্রে খবর মেলে, বিধায়কের বাড়ির শৌচাগারের লফ্ট থেকে সাত লক্ষ ৯০ হাজার টাকা উদ্ধার হয়েছে।
তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, জাফিকুলের ‘বেডরুম’ থেকেও প্রায় ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া বাড়ির অন্যান্য ঘর থেকে কয়েক লাখ টাকা মিলেছে। সব মিলিয়ে বিধায়কের বাড়ি থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলেই ওই অংশের দাবি। যদিও এ ব্যাপারে সিবিআইয়ের তরফে প্রকাশ্যে বা সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি।
১২ ঘণ্টা পর রাত সওয়া ৮টা নাগাদ জাফিকুলের বাড়ি থেকে বেরোন সিবিআই আধিকারিকেরা। সেই সময় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে দু’টি ব্যাগ ছিল। আর ছিল লাল কাপড়ে মোড়া কিছু জিনিস। সিবিআই সূত্রে দাবি, বিধায়কের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া নগদ অর্থের একাংশ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, জাফিকুলের স্ত্রী বীণা সরকারের ঘরে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু সোনার গয়নার হদিসও মিলেছে। ওই সূত্রের দাবি, বীণা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, কলেজের অধ্যক্ষা হিসেবে তিনি যে বেতন পান, সেখান থেকেই এই সোনা কেনা। যদিও সেই সংক্রান্ত কোনও নথি এখনও তিনি দেখাতে পারেননি। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে লাল কাপড়ে মোড়া যে জিনিস দেখা গিয়েছে, তা ‘বাজেয়াপ্ত’ হওয়া গয়না বলেই মনে করা হচ্ছে। সিবিআই সূত্রে খবর, এ ছাড়াও দু’টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
কিন্তু কে এই ব্যবসায়ী-বিধায়ক জাফিকুল? প্রতিবেশীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ডোমকল পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে গোবিন্দপুর এলাকার বাড়িতে একটি কয়েন বুথের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন জাফিকুল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েন বুথের দোকান চালানোর সময়েই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ৫৩ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়েছিলেন জাফিকুল। তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়। অভিযোগ ওঠে, মসজিদের সম্পত্তি নিজের নামে দেখিয়ে সেই ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। কলকাতা হাই কোর্ট থেকে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়। যদিও সেই টাকা পরে শোধ করে দেন জাফিকুল। কিন্তু তার পরেই তিনি ‘নিরুদ্দেশ’। প্রতিবেশীদের একটি সূত্রের দাবি, ২০১৪ সালের ওই ঘটনার পর ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে গিয়েছিলেন জাফিকুল। চলে গিয়েছিলেন কাশ্মীর।
রাজনীতিতে জাফিকুলের উত্থান খুব বেশি দিন নয়। তৃণমূল সূত্রে খবর, ডোমকলে ফিরে আসার পর তৃণমূলের প্রয়াত প্রাক্তন সাংসদ মান্নান হোসেনের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ জাফিকুলের। অভিযোগ, সেই পাচার কারবারের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
এলাকাবাসীর দাবি, রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকেই রকেটগতিতে উত্থান শুরু হয় জাফিকুলের। প্রচুর টাকাও করেছিলেন সেখান থেকে। সেই সময় বাড়িতে মুড়ির কল খোলেন। যার নাম ‘মা ভবানী মুড়ির মিল’। তখন থেকেই একের পর এক বিএড-প্যারামেডিক্যাল কলেজ গড়েন জাফিকুল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর সাতটি বিএড কলেজ, তিনটি প্যারামেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। রয়েছে দু’টি ডিগ্রি কলেজও। দাবি, একটি পেট্রল পাম্পও রয়েছে জাফিকুলের।
তৃণমূল সূত্রের জানা যায়, মূলত নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজের মাঠে রাজনৈতিক বিভিন্ন সভা করাকে কেন্দ্র করেই মান্নান হোসেন এবং তাঁর পুত্র সৌমিক হোসেনের কাছের লোক হয়ে ওঠেন জাফিকুল। পুরভোটে ডোমকলের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়ে কাউন্সিলরও হন।
কিন্তু তার পর থেকেই সৌমিকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে থাকেন জাফিকুল। সেই সময়েই তৎকালীন জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী (যিনি এখন বিজেপিতে এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা)-র সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক হয়। সৌমিকের বিরুদ্ধে পুরসভায় অনাস্থাকে ঘিরে ডামাডোলের মধ্যে পুরপ্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাফিকুলের।
দলীয় সূত্রে খবর, ২০১৯ সাল থেকে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (যিনি বর্তমানে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলবন্দি)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। দলেরই একাংশের দাবি, সেই সূত্রেই ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ডোমকল থেকে প্রার্থী হন জাফিকুল। প্রায় ৪৭ হাজার ভোটে সিপিএমের প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমানকে হারিয়ে বিধায়ক হন।
২০২১ সালের পর থেকে তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে জাফিকুলের। মানিকও নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন।
বেশ কয়েক বার বিতর্কেও জড়িয়েছেন জাফিকুল। এক সময়ে গরু পাচারের অভিযোগে তাঁর নাম জড়িয়েছিল। ২০২২ সালেও ডোমকলের প্রাক্তন ব্লক তৃণমূল সভাপতি প্রদীপ চাকীকে তাঁর অফিসে ঢুকে মারধরের অভিযোগও ওঠে জাফিকুলের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে।
সেই জাফিকুলের নামও এ বার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার নিয়ে ইতিমধ্যেই নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে শাসকদল তৃণমূল। এ ব্যাপারে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘কোনও কোনও সূত্রে বলা হচ্ছে, জাফিকুলের বাড়ি থেকে টাকা পাওয়া গিয়েছে। সেই টাকা বৈধ না অবৈধ, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। যদি ব্যবসার টাকা হয়, তা হলে তার বৈধতা নিয়ে কার কী বলার আছে? আর যদি অবৈধ হয়, তা হলে দলের অবস্থান আগেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন— জ়িরো টলারেন্স।’’