ছবি: ফেসবুক।
দেশ জুড়েই উৎসব পালিত হয় দেবীপক্ষে। কোথাও দুর্গাপুজো, কোথাও নবরাত্রি, আবার কোথাও শুধু দশেরা। কিন্তু অনেকেই বলেন, উৎসবের সবচেয়ে আকুল চেহারার দেখা একমাত্র কলকাতাতেই মেলে। দুর্গাপুজোয় কূলছাপানো উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় গোটা শহর। জনপ্লাবন আছড়ে পড়ে মহানগরের প্রান্তে প্রান্তে। এই বিপুল সমারোহকে সুস্থ, নির্বিঘ্ন এবং পথ অবরুদ্ধ হতে না দিয়ে জনপ্লাবনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মোটেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু গত বেশ কয়েকটা বছরের মতো এ বারও কলকাতা পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে সামলে রাখল পরিস্থিতি। মোটের উপর নিরাপদেই কাটল উত্সব। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে কলকাতার ট্র্যাফিক পুলিশের দক্ষ পথ-সঞ্চালনা। সব দিক বিবেচনা করেই এ বার কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশকে ১০-এর মধ্যে আট নম্বর দিচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন।
আয়তন, জনসংখ্যা, যানবাহনের সংখ্যার অনুপাতে রাস্তার সংখ্যা বা পরিমাণ যে কলকাতায় অনেকটাই কম, তা নতুন কথা নয়। ফলে শহরের সড়ক পরিবহণকে মসৃণ ভাবে সচল রাখা সারা বছরই বেশ কঠিন কাজ। পুজোর সময় সেই পরিস্থিতি আরও দুরূহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ বার গোটা পুজো-পর্বেই তত্পরতায় সঙ্গে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা সামলেছে পুলিশ। গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপুজোর উৎসবের সূচনা ক্রমেই এগিয়ে এসেছে। এ বার তো প্রতিপদ থেকেই কার্যত পুজো শুরু হয়ে যেতে দেখা গিয়েছে শহরে। তৃতীয়া ও চতুর্থীর জনসমুদ্র সামলাতে বেশ বেগও পেতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশকে। কিন্তু তার পরই শহরের মূল সড়কগুলি থেকে ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছিল যানজট! নেপথ্যে চার অস্ত্র— ১) রাস্তায় পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি, ২) যানজটের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যারিকেডিং, ৩) কুইক রেসপন্স টিম তৈরি রাখা এবং ৪) অভিজ্ঞতা।
ট্র্যাফিক পুলিশের একটি অংশের মতে, মহালয়ার পর থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত বহু মানুষ রাস্তায় বেরোন। পুজো মণ্ডপের উদ্বোধন আগে থেকেই হয়ে যায় বলে অনেকেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়েন। সেই সময় প্রচুর মানুষ কেনাকাটাও করতে বেরোন। তার ফলে বিভিন্ন মার্কেট চত্বরে ভিড় থাকেই। তখনও স্কুল, কলেজ, অফিস খোলা থাকায় সেই ভিড় তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে ওই সময়ে ভি়ড়টা একটু বেশিই হয়। কিন্তু পঞ্চমীর পর থেকে মানুষ মূলত ঠাকুর দেখতেই রাস্তায় নামেন। ফলে সেই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এখন আয়ত্তের মধ্যেই থাকে। লালবাজার সূত্রে খবর, এ বছর তৃতীয়া, চতুর্থী থেকে শহরের রাস্তায় অতিরিক্ত পুলিশ নামানো হয়েছে। সেই সংখ্যাটা পঞ্চমী থেকে নবমী পর্যন্ত আরও বেড়েছে। রাস্তায় ছিলেন অন্তত ১৪ হাজার পুলিশ। পাশাপাশি নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ১৮ জন উপ-নগরপাল পদমর্যাদার পুলিশকর্তা। ছিলেন ৮২ জন সহকারী নগরপাল পদমর্যাদার আধিকারিকও। এ ছাড়া ২৩০ জন ইনস্পেক্টরও রাস্তায় ছিলেন পুজোর ক’দিন।
তবে শুধু কি রাস্তায় পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেই হয়? কোথায় পুলিশ মোতায়েন করতে হবে, তা বেছে নেওয়াও ভীষণ জরুরি এ ক্ষেত্রে। লালবাজারের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘পঞ্চমীর আগে পর্যন্তই শহরের বিভিন্ন বাজার এলাকায় পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল। ওই সময় প্রচুর মানুষ পুজোর কেনাকাটা করতে বেরোন। ফলে মার্কেট এলাকাগুলিতে যানজটের সমস্যা তৈরি হয়। তার পর পুজো শুরু হলে সেই মতো ব্যবস্থা।’’ ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রেই খবর, পুজোর সময়ে শহরের পার্কিং জ়োনগুলি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সে ব্যাপারে ট্র্যাফিক গার্ডগুলির কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। কোন কোন রাস্তায় পুজোর সময়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা যায় বা যায় না, কোথায় দর্শনার্থীদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকে, সেই সংক্রান্ত রিপোর্টও পৌঁছেছে লালবাজারে। রাস্তার দিক নির্দেশক বোর্ডগুলিতে পুজোর সময়ে কোনও কিছু বদল করার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হয়েছে। ‘নো এন্ট্রি, নো পার্কিং’-এর সঙ্গেই কোন কোন রাস্তায় ভিড় সামলানোর জন্য ব্যারিকেড দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছিল। সেই মতো সমস্ত পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রে খবর, পুজোর ক’দিন শহর জুড়ে প্রায় ৫১টি নজর-মিনার প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। নাইট বাইনোকুলার দিয়ে সেখান থেকে নজরদারি চালানো হয়েছে। ছিল ৩০টি অ্যাম্বুল্যান্স, ৩০টি বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, ১৩টি হেভি রেডিয়ো ফ্লাইং স্কোয়াড, ৩০টি পিসিআর, ২০টি মহিলা পুলিশের ‘উইনার্স’ টিম এবং ১৬টি কুইক রেসপন্স টিমও। গঙ্গার ঘাটগুলিতে থাকছে অতিরিক্ত বন্দোবস্ত। ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুজোর দিনে যানশাসনই অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় দেখা যায়, রাস্তায় কোনও গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়ে যানজট তৈরি হচ্ছে। দ্রুত যাতে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেই এত সব ব্যবস্থা। রাস্তায় পুলিশ নামানোর পাশাপাশি ক্যামেরাতেও নজরদারি চালানো হয়েছে।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে শহরের যানজট সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশের সব চেয়ে হাতিয়ার হল তাদের অভিজ্ঞতা। লালবাজার সূত্রে খবর, ভিড়ের জন্য সাধারণত কোন কোন রাস্তা বন্ধ রাখতে হবে, কোন কোন পথে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে— গত বছরের থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট আগে থেকেই তৈরি ছিল। সেই মতো সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দু’পাশে বাঁশের ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি অংশেও দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত ব্যারিকেড। পুলিশের নিচুতলার কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, শোভাবাজার রাজবাড়িতে দিনের বেলায় বাসে করে প্রচুর দর্শনার্থী আসেন। অতীতে দেখা গিয়েছে, পুলিশকর্মী কম থাকায় ওই রাস্তায় তখন যত্রতত্র বাস দাঁড়িয়ে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়। সেই বিষয়টি নজরে রেখে এ বার সকাল থেকেই সেখানে অতিরিক্ত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। গত দু’বছর ধরে পুজোর সময়ে যান চলাচল ও ভিড় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লালবাজারকে বড় বেগ পেতে হয়েছে রাসবিহারী মোড় এবং চেতলা সেন্ট্রাল রোডে। ভিড় সামলে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বার বার সেখানে ছুটে যেতে হয়েছে লালবাজারের কর্তাদের। তাই এ বার চেতলা সেন্ট্রাল রোডেও অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রূপেশ কুমার বলেন, ‘‘আগে থেকেই সমস্ত পরিকল্পনা করে রাখা ছিল আমাদের। সেই মতোই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথায় পার্কিং জ়োন করা হবে, কোথায় ব্যারিকেড করা হবে— সব খতিয়ে দেখে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও পুলিশকর্মীরা নিরলস পরিশ্রম করেছেন এই ক’দিন।’’
সুষ্ঠু ভাবে ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য সহযোগিতা করায় পুজো কমিটিগুলিকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছেন পুলিশকর্মীদের একাংশ। ক্লাবগুলিও কুর্নিশ জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসনকে। বড়িশা ক্লাবের ক্লাব সভাপতি তথা ১৬ নম্বর বরো কমিটির চেয়ারম্যান সুদীপ পোল্লে বলেন, ‘‘২০২০ সালে অতিমারির সময় আমরা দেখেছিলাম, মানুষ ঠাকুর দেখতে বেরোলেও ভিড় হচ্ছে না! কিন্তু এ বার কোভিডের আগে যেমন জনসমাগম হত, তেমনই হয়েছে। কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে সঠিক নজরদারি ও উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকায় ভিড় সামাল দিতে আমাদেরও কোনও অসুবিধা হয়নি। এমনকি ডায়মন্ড হারবার রোডে যেমন যানজট চোখে পড়ত, তা-ও এ বার ছিল না। তৃতীয়ার দিন মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পুজোর উদ্বোধন করেছিলেন। তার পর থেকে প্রচুর মানুষ এসেছেন। প্রশাসন সজাগ থাকায় আমরা মসৃণ ভাবে পুজো পরিচালনা করতে পেরেছি।’’
হাতিবাগান নবীন পল্লীর পুজো কমিটির কর্তা সৌভিক ভড়ও বলছেন, ‘‘আমাদের পুজো মণ্ডপে আসার জন্য তিনটে রাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল— অরবিন্দ সরণি, বিধান সরণি ও এপিসি রোড দিয়ে। দশমীর দিন ভোরবেলা ভিড়ের কারণে মণ্ডপের কাছে পূর্ত দফতরের ব্যারিকেড ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশি তৎপরতায় দ্রুত সেই ব্যারিকেড আবার তৈরি করা হয়। তার ফলে আমাদের পক্ষেও জনস্রোত সামাল দিতে সুবিধা হয়েছে।’’ টালা প্রত্যয়ের শুভাশিস সোমের কথায়, ‘‘টালা থানার খুব কাছে আমাদের পুজো হয়। তাই পুলিশ প্রশাসনকে যেমন সচেতন থাকতে হয়, আমাদেরও তেমনই নিজেদের দায়িত্ব পালনে সতর্ক থাকতে হয়। পুজোর দিনগুলিতে আমাদের এখানে যে রকম জনসমাগম হয়েছে, তা কলকাতা পুলিশ ও আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকলে সম্ভব হত না।’’ কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক পরিচালনার প্রশংসা করেছেন বেহালা নূতন দলের কর্তা দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ও।
কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের ‘যানশাসনে’ একই প্রতিক্রিয়া একটি বড় অংশের দর্শনার্থীদেরও। কালিন্দি থেকে ঠাকুর দেখতে এসেছিলেন মঞ্জুষা মাজি। তিনি বলেন, ‘‘নিজেদের গাড়ি নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, অনেক জায়গাতেই জ্যামে আটকাতে হবে। কিন্তু তাজ্জব হয়ে গেলাম এটা দেখে যে, কোথাও সেই ভাবে বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে হল না। বেশি সিগন্যালেও পড়তে হয়নি। যার ফলে উত্তর থেকে দক্ষিণ সব জায়গাই ভাল ভাবে ঘুরে দেখতে পেরেছি।’’ যানজটে পড়ার ভয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ঠাকুর দেখা সেরে ফেলতেন সল্টলেকের বাসিন্দা আলো কর। তিনি বলেন, ‘‘সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যত ক্ষণ রাস্তায় থেকেছি, কখনওই সেই ভাবে যানজটে পড়তে হয়নি।’’
২ নম্বর যে কাটা গিয়েছে, তার কারণ— শহরের সর্বত্র যে সব সময়েই যানজট মুক্ত ছিল, তা নয়। কখনও কখনও জায়গায় জায়গায় যানজটে প়ড়তে হয়েছে অনেক মানুষকেই। তৃতীয়া থেকেই ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে ছিলেন বাগুইআটির বাসিন্দা সুজিত মাজি। তিনি জানান, তৃতীয়ায় শ্রীভূমির ঠাকুর দেখতে গিয়ে যানজটে প়ড়তে হয়েছে তাঁকে। দক্ষিণেও কয়েকটি জায়গায় যানজটে পড়েছেন তিনি। পুলিশের ব্যারিকেডের কারণেও বহু জায়গায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে অভিযোগ করেছেন অনেকে। ফলে, কলকাতার রাস্তাঘাট যে সকলের জন্যই যানজটমুক্ত ছিল, সে কথাও বলা যায় না। তার জন্য কাটা গিয়েছে এক নম্বর।
আবার পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতারও অভিযোগ উঠেছে। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর কর্তা তথা বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষ সেই অভিযোগ তুলেছেন। এ বারের কলকাতার পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল লেবুতলা পার্কের এই পুজো। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অযোধ্যায় দ্বারোদ্ঘাটন হবে রামমন্দিরের। তার আদলেই তৈরি হয়েছে ওই পুজো মণ্ডপ। সজল বলেন, ‘‘পুজোর ক’দিন লাখে লাখে মানুষ এসেছেন আমাদের পুজো মণ্ডপে। আমরা সে ভাবে পুলিশের সহযোগিতা পাইনি। কখনও রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কখনও আবার পথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই দর্শনার্থীদের ধন্যবাদ, তাঁদের সহযোগিতা না থাকলে আমাদের প্রয়াস সফল হত না।’’ এর জন্যও আরও এক নম্বর কাটা গিয়েছে।