আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব মিশ্র, প্রবীণ ত্রিপাঠি এবং ভোলানাথ পান্ডে।
মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি রাজ্যের সঙ্ঘাত কি তিন আইপিএস অফিসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল? সোমবার সকাল থেকে রাজ্য প্রশাসনে নতুন করে এই জল্পনা শুরু হয়েছে। ওই তিন অফিসার হলেন ভোলানাথ পান্ডে, প্রবীণ ত্রিপাঠি এবং রাজীব মিশ্র। বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পর ওই তিনজনকে তলব করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তখনও তাঁদের ছাড়তে রাজি হয়নি নবান্ন। তাঁরা এখনও রাজ্যেই আছেন। আলাপন-অধ্যায়ে নতুন করে যে আমলা-সঙ্ঘাত শুরু হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ওই তিন আইপিএসের উপর পড়বে কি না, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশে। যদিও প্রশাসনিক মহলের একাংশের বক্তব্য, তিন আইপিএসের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’। ওই নিয়ে আর নতুন করে কোনও পদক্ষেপ না করার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রসঙ্গত, গত ১০ ডিসেম্বর ডায়মন্ড হারবারে নড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পর ওই তিন আইপিএস অফিসারকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদে বদলি করেছিল কেন্দ্র। ঘটনার পরেই ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপার ভোলানাথ, ডিআইজি প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ প্রবীণ এবং আইজি দক্ষিণবঙ্গ রাজীবকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে বদলি করা হয়। যদিও তাঁদের কেন্দ্রীয় পদে যোগ দেওয়ার ছাড়পত্র (এনওসি) দেয়নি রাজ্য। কেন্দ্র-রাজ্যের সেই দড়ি টানাটানির মধ্যেই তাঁদের মধ্যে এক জন আইপিএস অফিসারকে বদলি করে রাজ্য সরকার। অপর জনের পদোন্নতি হয়। কেন্দ্র বদলির নির্দেশ দেওয়ার পরেও সেই অফিসারকে রাজ্য নিজের মতো পদে বসাতে পারে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয় পুলিশ মহলে।
ঘটনার দিন ভোলানাথ ছুটিতে ছিলেন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের কারণে। হামলার ঘটনা ঘটে তাঁর তিন দিনের ছুটির তৃতীয় দিনে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ঘটনার পরদিন ভোলানাথের কাজে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান, অসুস্থ থাকায় তিনি আরও একদিন ছুটি বাড়াতে চান। তা মঞ্জুরও করা হয়। কিন্তু ঘটনার সময় রাজ্যে অনুপস্থিত থাকলেও ঘটনার ‘দায়’ তিনি এড়াতে পারেন না বলেই মনে করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাই অন্য দু’জনের সঙ্গে তাঁকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। না যাওয়ায় বদলিও করা হয় কেন্দ্রীয় সংস্থায়।
তার পর থেকে তিন অফিসার রাজ্যেই রয়েছেন। কারণ, প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সরকারের উচ্চ মহল থেকে তাঁদের হয়ে ‘প্রেয়ার’ জমা পড়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। সেই আবেদনে তাঁদের রাজ্যে থাকতে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছিল। তিন অফিসারের তরফেও আলাদ করে আবেদন করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ওই তিন অফিসারের মধ্যে একজনের গুরুতর রোগ ধরা পড়েছিল। ফ?ে বিষয়টি মানবিক দিক দিয়েও দেখা হয়েছিল। তৃতীয়ত, নড্ডার পরবর্তী সফরগুলির সময় ওই তিন অফিসার তাঁদের ‘কর্তব্য এবং দায়িত্ব’ ঠিকঠাক পালন করেছিলেন বলেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রিপোর্ট গিয়েছিল। ফলে কেন্দ্র তাঁদের বিষয়টি খানিক ‘লঘু’ করে দেখছিল। তিন ‘বিতর্কিত’ আইপিএস অফিসারকে বদলি করা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার কথাও ভেবেছিল রাজ্য সরকার। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
তিন আইপিএসের বদলি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সঙ্ঘাতের সময় মোদী সরকার যুক্তি দিয়েছিল, আইপিএস ক্যাডার বিধি অনুযায়ী এ বিষয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সেই ক্যাডার বিধির নিয়মকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয় গত জানুয়ারি মাসে। ওই বিধিনিয়ম খারিজ করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে মামলায় যুক্তি দেওয়া হয়, ওই নিয়ম সংবিধানের বিরোধী। কলকাতার আইনজীবী আবু সোহেল মামলাটি করেছিলেন।
আলাপনকে নিয়ে যে সঙ্ঘাতের আবহ তৈরি হয়েছে (কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে), তাতে ওই তিন আইপিএসের ‘গুরুদন্ড’ হবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। প্রশাসনের একাংশের অনুমান, কেন্দ্রীয় সরকার অতঃপর বিষয়টিকে ততটা ‘লঘু’ করে দেখতে না-ও পারে। বিশেষত, যখন আলাপনের বদলির নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আবেদন জানালেও তাতে কর্ণপাত করেনি কেন্দ্র।
প্রসঙ্গত, আইপিএস ক্যাডার আইনের ৬ (১) ধারায় বলা রয়েছে, এমন কোনও বিষয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মতানৈক্য হলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই বলবৎ থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি আবার ওই তিন অফিসারকে তলব করে নতুন দায়িত্বে যোগ দিতে বলে এবং রাজ্য তাঁদের আবার না ছাড়ে, তা হলে তাঁদের কর্মজীবনে কী প্রভাব পড়বে? প্রশাসনের অভিজ্ঞ আধিকারিকদের বক্তব্য, সেক্ষেত্রে তাঁরা রাজ্যে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ‘সরকারি মেসেজ’ পাঠিয়ে নতুন দায়িত্বে যোগ দিতে পারেন। তাঁরা তা না করলে নতুন পদে তাঁদের অনুপস্থিতি বিনা বেতনে ছুটি হিসাবে গণ্য হবে। মাসের পর মাস তেমন হতে থাকলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাঁদের সাসপেন্ড করতে পারে বা অন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে সেটা একান্ত ভাবেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিবেচ্য। যদিও প্রশাসনিক মহলের একাংশের বক্তব্য, তিন আইপিএসের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’। ওই নিয়ে আর নতুন করে কোনও পদক্ষেপ না করার সম্ভাবনাই বেশি।