RG Kar Case Verdict

চুল ও ব্লুটুথে পুলিশি ‘ষড়যন্ত্রের’ তত্ত্ব চর্চায়

সোমবার শিয়ালদহ দায়রা আদালতের রায়ে আর জি কর-কাণ্ডের খুন, ধর্ষণে সঞ্জয়কে বিচারক আমরণ কারাবাসের সাজা দিলেও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের খুঁটিনাটিতে কার্যত অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:২৯
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

ভরা এজলাসে প্রকাশ্যে গলার রুদ্রাক্ষের মালার কথা জানিয়ে তাকে দোষী সাজানো হয়েছে বলে সঞ্জয় রায়ের আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা রায়ের আগে শুনানির সময়ে সামনে এসেছে। কিন্তু রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুনানির সময়ে তদন্তে সংগৃহীত সব তথ্যপ্রমাণ এবং সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সঞ্জয় যা যা বলেছে, তা-ও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজ্ঞেরা। বিচারকের সামনে বয়ান দেওয়ার সময়ে কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করে এক পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত তুলে ধরে। সঞ্জয় যা বলেছে, তা প্রমাণ করা না গেলেও, বিচারক অনির্বাণ দাস নিজেও সিবিআই ও কলকাতা পুলিশের তদন্ত নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন।

Advertisement

সোমবার শিয়ালদহ দায়রা আদালতের রায়ে আর জি কর-কাণ্ডের খুন, ধর্ষণে সঞ্জয়কে বিচারক আমরণ কারাবাসের সাজা দিলেও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের খুঁটিনাটিতে কার্যত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বাজেয়াপ্ত সামগ্রীতে সঞ্জয়ের আঙুলের ছাপের অভাব থেকে নানা ধোঁয়াশার চিহ্নের কথা রায়ে বলা হয়। সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল তথ্যপ্রমাণ মিললেও সামগ্রিক ভাবে নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার শরীর থেকে উদ্ধার হওয়া নমুনায় নানা গোলমেলে দিকেরও সন্ধান মিলেছে। এমনকি নমুনায় অন্য এক মহিলার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলার মতো বিভ্রান্তিকর দিকও বিচারকের নজরে আসে।

এত জট পাকানো প্রশ্নের মধ্যে কোর্টে দোষী সঞ্জয়ের বয়ানও উড়িয়ে দেওয়ার নয় বলে আইনজ্ঞদের মত। মামলার বিচার প্রক্রিয়া অনুযায়ী, ভারতীয় নাগরিক ন্যায় সংহিতার ৩৫১ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক সাক্ষীর বয়ান লিপিবদ্ধ করার পরে বিচারক অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের বয়ান নথিভুক্ত করেন। পড়ুয়া-চিকিৎসক খুন, ধর্ষণের মামলায় আদালতের রুদ্ধদ্বার কক্ষে সঞ্জয়-সহ ৫১ জন সাক্ষীর বয়ানও লেখেন বিচারক। কোর্ট সূত্রের খবর, গলার রুদ্রাক্ষের মালার মতো মৃতদেহের পাশ থেকে তার মাথার ছোট ছোট চুল উদ্ধার নিয়েও সঞ্জয় জোরদার ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই’ মেলে ধরেছিল। সেই সঙ্গে তার শরীরের ক্ষতচিহ্নের সঙ্গে ধর্ষণের যোগসূত্রও অস্বীকার করেছে। সব সাক্ষীর বয়ানের ভিত্তিতে বিচারক সঞ্জয়কে ১০৪টি প্রশ্ন করেছিলেন, দাবি আদালত সূত্রের। খুন, ধর্ষণের নামগন্ধ ছাড়া কলকাতা পুলিশের ওয়েলফেয়ার কমিটির কাজে আর জি করের ইমার্জেন্সি ভবনের চার তলায় ঘোরাঘুরির কারণ জানায় সঞ্জয়। চেস্ট মেডিসিন বিভাগে তার মোবাইলের ব্লুটুথ হেডফোন পড়ে থাকার সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যাও বিচারকের সামনে দেয় সে।

Advertisement

কোর্টের নথি বলছে, বিচারকের ৩২ ও ৩৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয় জানায়, ৯ অগস্ট রাতে লালবাজারে নিয়ে আসার পরে সঞ্জয়ের গলার রুদ্রাক্ষের মালা, মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারেরা নিয়ে নেন। লক-আপে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় খুলে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। মাথার চুলও ছিঁড়ে নেওয়া হয়। ডাক্তার ছাত্রীর দেহের পাশ থেকে সঞ্জয়ের মাথার ছোট ছোট চুল উদ্ধার হয়েছিল বলেই কলকাতা পুলিশের তরফে দাবি করে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে জমা দেওয়া হয়। সঞ্জয়ের বক্তব্য, পরের দিন অর্থাৎ ১০ অগস্ট সকালে তাকে এক আইপিএস কর্তা বলেন, “খুন, ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করে নাও। পরে সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।” কিন্তু সে দোষ স্বীকার করতে রাজি হয়নি। এর পরে তাকে প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলে তিনিও একই কথা বলেন, কোর্টে দাবি করেছে সঞ্জয়। তার দাবি, রাজি না হওয়ায় ফের তাকে মারধর করা হয়। এসএসকেএমে নিয়ে গিয়ে তার দেহের ক্ষতচিহ্নের পরীক্ষা ও ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়।

দেহের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে সঞ্জয়ের বক্তব্য, ৫ অগস্ট কলকাতা পুলিশের এএসআই অনুপ দত্তের সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের সালুয়ায় গিয়ে ‘ক্লাইম্বিং’ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল সে। তখনই পড়ে গিয়ে শরীরের নানা জায়গা ছড়ে যায়। পরে ওই ক্ষতই ধর্ষণজনিত কারণে বলে তদন্তকারীরা দাবি করেন। সিসি ক্যামেরায় চেস্ট মেডিসিনের চার তলার সেমিনার হলের আশপাশে তার ঘোরাঘুরির ডিজিটাল তথ্যপ্রমাণ নিয়ে বিচারকের সামনে মুখও খুলেছে সঞ্জয়। বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয়ের দাবি, পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্য অনুপ দত্তের নির্দেশে ৮ অগস্ট সন্ধ্যায় এক রোগীর দেখাশোনার জন্য সে হাসপাতালে যায়। ইমার্জেন্সি ভবনের তিন তলা ও চার তলায় ঘুরে ঘুরে ওই রোগীরই সে খোঁজ করেছিল। সে জন্যই সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তার ছবি। নথিতে প্রকাশ, ওই রোগীর খোঁজ না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে চেস্ট মেডিসিনের পুরুষ ওয়ার্ডের একটি খালি বেডে শুয়ে পড়ার কথা বিচারককে জানায় সঞ্জয়। পরে ভোরের দিকে হেলমেট নিয়ে সকালে হাসপাতাল ছেড়ে সে বেরিয়ে যায়। ওই সময়ে তার গলায় থাকা মোবাইলের ব্লুটুথ হেডফোনটি ওই ওয়ার্ডে থেকে গিয়েছিল। বিচারকের একাধিক প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয়ের দাবি, তার বিরুদ্ধে যাবতীয় ফরেন্সিক নমুনা সাজানো বা ‘প্লান্ট’ করা হয়েছিল। পরে প্রকাশ্যেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সঞ্জয় বিচারককে বলে, “আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। ধস্তাধস্তিতে ওই মালা ছিঁড়ে যেতে পারত। কলকাতা পুলিশ মালাটি কেড়ে নিয়েছে।”

আইনজ্ঞদের একাংশের মতে, বিচারক সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করলেও সব বয়ান শুনে ও তথ্যপ্রমাণ দেখে তাকে কিছুটা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দেওয়ার অবকাশ রয়েছে বলে রায়ে আভাস মিলেছে। সম্ভবত তাই এই অপরাধ ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ মানতে না-চেয়ে বিচারক সঞ্জয়কে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে সিবিআইয়ের আইনজীবীদের বক্তব্য, “হেফাজতে থাকাকালীন জেরার সময়ে সঞ্জয় এ সব বলেনি। কোর্টে চার্জ গঠনের সময়ে এ সব বলতে শুরু করে। তখন সঞ্জয়ের বক্তব্যের ভিত্তিতে তদন্তের সুযোগ ছিল না। একমাত্র উচ্চ আদালতের নির্দেশেই সঞ্জয়ের বক্তব্য যাচাই করতে পারে তদন্তকারী সংস্থা।” ঘটনাচক্রে, চার্জ গঠনের দিনই কোর্টের বাইরে সংবাদমাধ্যমের সামনে সঞ্জয় চিৎকার করে বলে, “সিপি বিনীত গোয়েল আমাকে চুপ থাকতে বলেছিল। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement