(বাঁ দিকে) ব্রাত্য বসু। সিভি আনন্দ বোস। — ফাইল চিত্র।
বার বার একে অপরের দিকে আঙুল তুলেছেন। একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এ বার সেই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু পরিচালিত ছবি ‘হুব্বা’ দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে রাজভবনে দেখা করতে গিয়েছিল তৃণমূলের প্রতিনিধি দল। তখনই রাজ্যপাল জানান, তিনি হুব্বা দেখতে আগ্রহী। ব্রাত্য পাল্টা জানান, রাজ্যপাল কবে দেখতে চান জানালে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।
চোপড়ার শিশুমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার বোসের কাছে রাজভবনে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিল তৃণমূলের প্রতিনিধি দল। সেই দলে ছিলেন ব্রাত্য, কুণাল ঘোষ এবং চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-সহ ন’জন প্রতিনিধি। রাজ্যপালের সঙ্গে চোপড়া, বিএসএফ এবং সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয় তাঁদের। তার মাঝেই রাজ্যপাল ‘হুব্বা’ দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন।
২০২২ সালের ২৩ নভেম্বরে রাজ্যের রাজ্যপাল পদে শপথ নেন বোস। তার পরেই বাংলা শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁকে বাংলা শেখানোর সূচনা করতে ২০২৩ সালে ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রাজভবনে। নেপথ্যে ছিল রাজ্য সরকার। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসাবে শিক্ষা দফতরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার কথা জানান বোস। প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বার বার সংঘাতে জড়িয়েছিল রাজ্যের শিক্ষা দফতর। সংঘাত এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ২০২২ সালের বাদল অধিবেশনে বিভিন্ন সরকার অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে বসানোর বিল পাশ করেছিল রাজ্য সরকার। সেই বিল রাজভবনে আটকে রয়েছে। বোস রাজ্যপাল হওয়ার পর প্রথম দিকে সে রকম সংঘাতের আবহ তৈরি হয়নি। যদিও পরে তিনি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যে নিয়মে চলছিল, সেই নিয়মই বহাল থাকবে। তাই মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার বিল যে রাজভবনেই আটকে থাকবে তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন আনন্দ বোস।
শপথ নেওয়ার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। রাজ্য সরকারের চালু করা নীতি মেনে রাজভবনের তরফে শিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়েছিল আমন্ত্রণপত্র। কিন্তু সেই আবহ স্থায়ী হয়নি। ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বৈঠকের পর ব্রাত্য জানিয়েছিলেন, রাজভবনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করবে শিক্ষা দফতর। পরে ব্রাত্য জানিয়েছিলেন, সেই বৈঠকেই রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর শেষ বার কথা হয়েছিল। তাঁরা আলোচনার পক্ষে থাকলেও তা হয়নি। ক্রমে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সংঘাত তৈরি হয় রাজ্যের শিক্ষা দফতরের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একের পর এক অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করেন রাজ্যপাল বোস। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসানো হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শুভ্রকমল মুখোপাধ্যায়কে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক গৌতম মজুমদারকে উপাচার্য করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও নতুন উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি রাজভবনকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চালানোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেবে রাজ্য। সেই হুঁশিয়ারিতেও কাজ হয়নি। কৃষ্ণনগরের কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্য হিসাবে অধ্যাপক কাজল দে-কে নিয়োগ করেন রাজ্যপাল। এর পর রাজ্য সরকারের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের তলব করা হয়েছিল। অভিযোগ, ডাক পেয়েও উপেক্ষা করেছেন ১৭ জন। ব্রাত্য অভিযোগ করেছিলেন, রাজভবন থেকে এসএমএস করে হুমকি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। সে কারণে তাঁরা আসেননি।
এর পর রাজ্যপালকে কখনও ‘কবি’, কখনও ‘জেমস বন্ড’ বলেন ব্রাত্য। ব্রাত্যের কথায়, ‘‘রাজভবনে কবি বসে আছেন। কিন্তু কবি তুমি কুমোরের নয়, তুমি কামারেরও নয়। তুমি রাজার।’’ কখনও রাজ্যপালের পদকে ‘সাদা হাতি’-র সঙ্গে তুলনা করেন শিক্ষামন্ত্রী। ব্রাত্য এ-ও জানিয়েছিলেন, রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে মানছেন না রাজ্যপাল। তাঁকে অপমান করছেন। তিনি এ-ও জানান, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তার পরে সিদ্ধান্ত হবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুর পর রাজ্যপালের সঙ্গে শিক্ষা দফতরের সংঘাত আরও জোরালো হয়। রাজভবনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের বৈঠক ডেকেছিলেন আচার্য। রাজ্যপাল নিজের বাসভবনে এ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈঠক ডাকতে পারেন কি না, তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছিল। বৈঠকের পরেই নতুন অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্য নিয়োগ করেন আচার্য। গত ডিসেম্বরে সেই উপাচার্যকেই সরিয়ে দেন বোস। তাঁর অনুমতি ছাড়া সমাবর্তনের আয়োজন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেই নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন সম্পন্ন করানোর জন্য বুদ্ধদেবকে বিশেষ ক্ষমতা দেয় ব্রাত্যের শিক্ষা দফতর।
ক্রমাগত এই টানাপড়েনের মাঝেই বৃহস্পতিবার ব্রাত্য পরিচালিত ছবি দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন রাজ্যপাল। ব্রাত্য পাল্টা জানান, তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।