নিজের বাংলার শিক্ষক চিরঞ্জীব গঙ্গোপাধ্যায়কে (ডান দিকে) মঞ্চে ডেকে গুরুদক্ষিণা দিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস (মাঝে)। — নিজস্ব চিত্র।
রাজ্য শিক্ষা দফতরের সঙ্গে নতুন রাজ্যপালের সংঘাত প্রকাশ্যে এসেছে। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। শুক্রবারও ব্রাত্য বোসকে ‘মত্ত হাতি’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ বার সেই শিক্ষামন্ত্রীর দফতরের সুপারিশ করা শিক্ষককেই শনিবার মঞ্চে ডেকে সংবর্ধনা দিলেন রাজ্যপাল বোস। পয়লা বৈশাখে রাজভবনের অনুষ্ঠানে গড়গড়িয়ে বাংলায় ভাষণ দিলেন আনন্দ। আর সেই কৃতিত্ব নিজের বাংলার শিক্ষককেই দিলেন রাজ্যপাল।
‘হাতেখড়ি’র ৮০ দিনের মাথায় শনিবার, পয়লা বৈশাখে বাংলায় ভাষণ দিলেন রাজ্যপাল। তার পর নিজের বাংলার শিক্ষক চিরঞ্জীব গঙ্গোপাধ্যায়কে মঞ্চে ডেকে গুরুদক্ষিণা দিলেন। হেয়ার স্কুলের বাংলার শিক্ষক চিরঞ্জীবের নাম সুপারিশ করেছিল উচ্চশিক্ষা দফতর। সময়ের অভাবে প্রতি সপ্তাহে বাধাধরা ক্লাস বোস করতে পারেন না। তাই ফাঁকা থাকলে রাজভবন থেকে খবর পাঠানো হয় চিরঞ্জীবকে। তখন তিনি রাজভবনে গিয়ে বাংলা পড়িয়ে আসেন।
মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া বর্ণপরিচয় দিয়েই রাজ্যপালের বাংলার পাঠ শুরু হয়েছিল। তার পর একে একে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’, ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন। এখন ফোনেটিকসের উপর জোর দিচ্ছেন। চিরঞ্জীব জানিয়েছেন, রাজ্যপাল চাইছেন তাঁর বাংলা উচ্চারণ হবে বাঙালিদের মতো। সেই চেষ্টাই করে চলেছেন।
শনিবার যে ভাষণ দিলেন রাজ্যপাল, তা সেই ‘চেষ্টা’রই ফল। চিরঞ্জীব জানিয়েছেন, রাজ্যপাল নিজেই লিখেছেন ভাষণ। তার পর রাজভবনের তরফে তার অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলায় কী বলেছেন বোস? তিনি বলেন, ‘‘উপস্থিত অতিথিগণ শুভ নববর্ষ। আমি বাংলাকে ভালবাসি। আমি বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করি। আমি সুভাষচন্দ্র বোসকে সম্মান জানাই। আমি স্বামী বিবেকানন্দকে সম্মান করি। আমি সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধা করি। বঙ্গভূমি আমার নিজের বাসভূমি। আমি বাংলার বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে চাই। আমি বাংলার পুত্ররূপে পরিচিত হতে চাই। আমি আমার হৃদয়ে, আমার রক্তে, বাংলাকে স্বীকার করব। আমি পবিত্র বাংলার অঙ্গ হতে চাই। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, জয় পশ্চিমবঙ্গ। জয় হিন্দ।’’ রাজ্যপালের পোশাকেও ছিল বাঙালি ছোঁয়া। তিনি পরেছিলেন তসরের পাঞ্জাবি আর পাজামা।
এ রকম ছাত্র পেয়ে তিনি গর্বিত বলেই জানিয়েছেন চিরঞ্জীব। তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যপাল বিভিন্ন ভাষা জানেন। বাংলা রপ্ত করতে ওঁর সমস্যা হচ্ছে না। ভাষা নিয়ে খুব আগ্রহী তিনি। যখন বাংলা শেখেন, তখন সেই নিয়ে আলোচনাও করেন। এর ফলে তিনিও অনেক কিছু শিখছেন। রাজ্যপালের শিক্ষা ‘একতরফা’ নয়। চিরঞ্জীব জানালেন, রাজ্যপালের ইচ্ছা, আরও বেশি করে বাংলায় ভাষণ দেবেন।
চলতি সপ্তাহে আচার্য হিসাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছেন রাজ্যপাল। প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, তার পর রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং শুক্রবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই পরিদর্শনের পরেই ব্রাত্য জানিয়ে দেন, তাঁর কাছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘নৈতিক আচার্য’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। যে সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই ২০২২ সালে বিধানসভায় বিল পাশ করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজভবন থেকে সেই বিল পাশ না হওয়ায় এখনও চূড়ান্ত করা যায়নি। শিক্ষা দফতরের সঙ্গে কথা না বলে কী ভাবে রাজ্যের অর্থ থেকে অনুদান ঘোষণা করেন বোস, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, তাঁর ফোনও ধরছেন না রাজ্যপাল।
যদিও রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষা দফতরের সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্ক এমনটা ছিল না। তখন শিক্ষামন্ত্রীই রাজভবনে উপাচার্যদের সঙ্গে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার পর এক সঙ্গে কাজ করার বার্তা দেন। এমনকি, রাজ্যপালের বাংলা শেখার জন্য উদ্যোগও নিয়েছিল শিক্ষা দফতর। তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বর্ণ পরিচয় দিয়ে এসেছিলেন। সরস্বতী পুজোর দিন রাজ্যপালের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছিল। তার পর তাঁর বাংলার শিক্ষকও ঠিক করে দেওয়া হয়। সেই শিক্ষককেই শনিবার সংবর্ধনা দিলেন রাজ্যপাল।
শিক্ষকের সঙ্গে ‘বাধ্য ছাত্র’ হয়ে উঠলেও তাঁর নিয়োগকারীর সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বেড়েছে রাজ্যপালের। শনিবারের সংবর্ধনায় কি সেই দূরত্ব মিটবে? থাকছে প্রশ্ন।