Ananda Puraskar

নেতা নন, ইতিহাস তৈরি করে জনগণই, অসীম-বোধে কুর্নিশ

ফুল ছিল, শ্যাম ছিল না। অসীমদের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময়েই তো ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ঘুণপোকা উপন্যাসে প্রতিবাদী, বিষণ্ণ শ্যামের ছবি এঁকেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:১২
Share:

অসীম চট্টোপাধ্যায়ের হাতে আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলন। শনিবার। ছবিঃ দেবকল্যাণ চৌধুরি।

সব থেকে উপরে কী? সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিস্পর্ধী হলুদ সূর্যমুখী? পাঁচতারা হোটেলের বলরুমের সাজানো মঞ্চের প্রেক্ষাপট শনিবার শুধুই ফুলের। আঁকা ছবিতে নীল ফুলদানি থেকে উপচে-পড়া নীল, খয়েরি, বেগুনিরঙা ফুল আর না-ফোটা কুঁড়ি। হরেক আকারের বর্ণিল পত্রসম্ভার। এই ফুল ও বাগিচা মুঘল ভারতের উত্তরাধিকার। সেই ফুল এবং রকমারি বাগান ছিল চিনদেশেও। সেখান থেকেই তো চা পাতা, ফুলের তোড়ার আইডিয়া গেল ইংল্যান্ড, ফ্রান্সে। হরেক পত্রপুষ্পে শোভিত এই তোড়া মনে পড়িয়ে দেয় পঞ্চাশের দশকে মাও জে দঙের বিখ্যাত সেই আশা, ‘শত পুষ্প বিকশিত হোক।’ সত্তর দশকের নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘নকশালবাড়িনামা’কে শ্রদ্ধা জানানোর এর থেকে বেশি রুচিস্নিগ্ধ উপায় আর কী হতে পারে! শনিবার সন্ধ্যায় এ রকম পরিবেশেই অসীমবাবুর হাতে আনন্দ পুরস্কার তুলে দিলেন বাংলাদেশের ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক, ঔপন্যাসিক ইমদাদুলহক মিলন।

Advertisement

বাংলাদেশের সঙ্গে নকশাল আন্দোলনের সম্পর্ক কি স্রেফ আজকের? মনে পড়ল, ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে পাশ করে বাংলাদেশের এডওয়ার্ডস কলেজে আইএসসি পড়তে গিয়েছিলেন অসীমের নেতা চারু মজুমদার। প্রয়াত গুরু আর শিষ্যে বহু আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও মতান্তরের পর শনিবারের আনন্দসন্ধ্যায় ফের মিলন।

ফুল ছিল, শ্যাম ছিল না। অসীমদের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময়েই তো ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ঘুণপোকা উপন্যাসে প্রতিবাদী, বিষণ্ণ শ্যামের ছবি এঁকেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। চাকরি চলে গিয়েছে, শ্যাম দাড়ি কামানোর সময়ে আয়নায় দেখতে পায়, তার নিরুচ্চার ঠোঁট দুটো ওপরওয়ালার উদ্দেশে বলে চলেছে, ‘বাস্টার্ড!’ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিবাদী জোশ না থাকলে তা কি এত প্রখর ভাবে আছড়ে পড়ত ষাট-সত্তরের বাংলা সাহিত্যে? অনুষ্ঠানে তাঁরই প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রারম্ভিক বক্তৃতায় জানা গেল, তিনি অসুস্থ। ইমদাদুল হক মিলন পৌরোহিত্য করলেন।

Advertisement

পুরস্কারের মানপত্র জানিয়েছে, অসীমবাবুর এই লেখায় আছে তাঁর অনুসৃত পথের দিশা: নকশালদের পথ ছাড়ো, নকশালপন্থার পথ ধরো। পুরস্কারপ্রাপক সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত কাকাসুলভ মেজাজে মাইকের সামনে এসে প্রতিবাদ জানালেন, ‘‘ভুল লেখা হয়েছে। ওটা হওয়া উচিত নকশালবাড়ির পথ ধরো।’’ মেজাজি এই চটজলদি প্রতিবাদেই তো তিনি অনন্য। আলিপুর জেলে তখন কাকা, জঙ্গল সাঁওতাল আর মহাদেব মুখোপাধ্যায় বন্দি। মহাদেব তখনও চারুবাবুকে নেতা মানেন, কাকা এবং জঙ্গল নন। রোজ দু’তরফে প্রবল ঝগড়া। সহবন্দি কানু সান্যাল জানিয়েছিলেন, শেষে এক দিন কাকা ও জঙ্গল মিলে সেলের মধ্যে মহাদেবকে দুমদাম মার।

কিন্তু সেটাও ৪৬ বছর আগে, ১৯৭৮ সালের কথা। এ দিন কাকা তাঁর কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে দর্শককুলে প্রবল হাততালি। মানপত্রের ছোট্ট এক লাইনের বিরুদ্ধে আচমকা লেখকের প্রতিবাদ এবং দর্শকের সমর্থন, এই গণতান্ত্রিকতাতেই পুরস্কার রজনীর অন্যতম সারাৎসার। নকশালবাড়ি ও নকশালপন্থাকে আলাদা করে দিলেন কাকা। চাষিদের তিরে পুলিশ ইনস্পেক্টর সোনাম ওয়াংদির মৃত্যু এবং সেখান থেকে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ও ফাঁসিদেওয়া গ্রামে পুলিশি অত্যাচারের গল্প কে না জানে! কিন্তু নিছক সন্ত্রাস নয়, সেটা তো জমিদার, মহাজনের বিরুদ্ধে গরিব চাষির আন্দোলনের ইতিহাস।

প্রাপক অবশ্য এই বইকে রাজনীতি, ইতিহাসের অভিধায় বাঁধতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা একটা ভ্রমণকাহিনি। মগরা থেকে কলকাতা, কৈশোর থেকে যৌবন, এই চলার পথে যা পেয়েছি, তার খতিয়ান। চলার পথে জেনেছি, পার্টি বা নেতা নয়। আসলে জনগণই ইতিহাস তৈরি করে।’’

ভাইয়া দাস সেটা অবশ্যই জানেন। সুবর্ণরেখার তীরে বহড়াগোড়া অঞ্চলে তাঁর নাম ছিল ভাইয়া দাস। এক দিন নদীর পাড়ে পুলিশ, অসীম ঝাঁপ দিয়ে নদীতে। তার পর ও পারে গিয়ে এক আখখেতে লুকিয়ে থাকা। এ পারের পুলিশ বলছে, ‘মনে হয় এখানে।’ কাকা লিখছেন, ‘যা বলুক, যতক্ষণ না শুয়োর খোঁচানোর মতো আমায় বের করবে, নিঃসাড়ে পড়ে থাকব।’ সে যাত্রা ফের ভরা নদীতে সাঁতার কেটে ফিরে আসা। লোকজন জানলে, ভাইয়া দাসকে পুলিশ ধরতে পারে না। এ ভাবেই তখন উপকথার জন্ম হত। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ও কমিক স্ট্রিপে। কেউ দেখেনি, কিন্তু জানে, ছোটবেলায় নেতা আস্ত কুমির ধরেছিলেন। আমরা যাইনি মরে আজও, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।

দৃশ্য কি শুধু বিপ্লবী অভিযানে? আত্মজীবনীতে বিধান ছাত্রাবাসের কথা আছে। সুবর্ণরেখা-খ্যাত ইন্দ্রনাথ মজুমদার তখন ২৮ জন আবাসিকের সেই হস্টেলে সুপার। লেখক লিখছেন, ‘যদিও বিধান ছাত্রাবাসে পরিচালক কমিটিতে অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্ল সেন, আভা মাইতির মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বরা ছিলেন, কোনও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা খবরদারির ব্যাপার সেখানে ছিল না। ছাত্ররা নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এমনকি, ছাত্র ফেডারেশনের প্রার্থী প্রেসিডেন্সি কলেজে নির্বাচিত হলেও তা নিয়ে প্রশ্নও উঠত না।’

কলেজ ইউনিয়নের কথা থাকুক। তারা সব দায়িত্ব হারিয়ে আজ কেবল অনলাইন ভর্তি ও তারকাখচিত জলসার উদ্যোক্তা। মা যা হয়েছেন সবাই জানেন। কিন্তু মা কী ছিলেন, সেই কথা অক্লেশে প্রকাশিত এই স্মৃতিকথকতায়।

এই নিস্পৃহ কথকতাই তো লিখতে পারে, ‘আমি আসলে সাহিত্যের ছাত্র। ভাল নম্বর থাকায় সহজেই প্রেসিডেন্সি কলেজে সাম্মানিক পদার্থবিদ্যায় ভরতি হয়েছি।’ আর্টস নয়, সায়েন্স পড়লেই মোক্ষ, এই মধ্যমেধার দাপট থেকে আজও কি মুক্ত হয়েছে বাঙালি?

সভামুখ্য ও প্রধান অতিথি ইমদাদুল হক বলছিলেন, এক রাজনৈতিক কর্মী যে তাঁর ষাট বছরের পথচলায় এত মানুষকে মনে রেখেছেন, সেখানেই তিনি হতবাক। এ তো লেখকের কাজ! প্রথম যখন সুবর্ণরেখার ধারে এক গ্রামে ‘ডিক্লাসড’ হওয়ার চেষ্টায় কাকা, বর্ণনাটা ভয়াবহ। ধান কাটতে পারছেন না, হাল দিতে গেলেও গা হাত পায়ে প্রবল ব্যথা। একদা বুকার পুরস্কারে মনোনীত বাঙালি নীল মুখোপাধ্যায়ের ‘দ্য লাইভস অব আদার্স’-এর নায়কও তো এ রকম কষ্টের কথাই লিখেছিল। সাহিত্য থেকে রাজনীতি, সবই যেন বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একাকার।

পথের ফারাক তো থাকতেই পারে। নকশালবাড়ি, শ্রীকাকুলাম, ইয়েনান প্রতিটি পথেরই থাকতে পারে নিজস্ব দাবি, নিজস্ব সংঘাত ও সমঝোতা। কিন্তু ষাট বছর আগের নকশালবাড়িনামা যেন বাঙালির শেষ মাইলফলক। সেখানে পিকিং রেডিয়োর জন্য সকলে অপেক্ষা করে থাকে, এবং শেষে মাও জে দং-ই এই আন্দোলনকে পাত্তা দেন না। এটা কৃষিবিপ্লবের পথ নয়। ভুল ছিল, শ্রেণিশত্রু খতমের নামে অনেক ভ্রান্ত হত্যা হয়েছে। নিচুতলার পুলিশকর্মী খতম হয়েছেন, কিন্ত সদর দফতরে কামান দাগা যায়নি। সেটাই বাঙালির ট্র্যাজেডি। সে বারংবার ব্যর্থতার গোলকধাঁধায় ঘুরেছে, এবং সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছে। স্বদেশি যুগে হেমচন্দ্র কানুনগোও তাঁর ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’ বইয়ে লিখছেন, অস্ত্রের টাকা জোগাড়ের জন্য তাঁরা বিধবাদের বাড়িতে ডাকাতি করতেন। কে বিপ্লবী, কে সন্ত্রাসী সেই সীমারেখা বারংবার পিছলে যায়।

অসীম অবশ্য এ দিনের বক্তৃতা শেষ করেছেন, ‘‘গণতন্ত্রই মানুষকে পথ দেখায়। গণতন্ত্র যেটা ছিল, আছে, থাকবে’’ এই বিশ্বাসে। তাঁর অভিজ্ঞতার সারাৎসার, পার্টি নয়, নেতা নয়, জনগণই ইতিহাস তৈরি করে। জনতা যতই দরিদ্র হোক, তার সে শক্তি আছে। নকশালবাড়ি, শ্রীকাকুলাম জনতার এই শক্তি দেখিয়েছিল। আজ লোকে ভুলে গিয়েছে, কিন্তু নকশালবাড়ির পথ তো মিজ়োরাম, জম্মু-কাশ্মীরেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিল। পথ নিয়ে বিতর্ক ছিল, কিন্তু সেখানে অসীমদের পাশে সত্যনারায়ণ সিংহের মতো বিহারের নেতাও ছিলেন। ছিলেন অন্ধ্রের নেতারা। খতম লাইনে ভুলভাল ছিল, কিন্তু অসীমদের আন্দোলন সারা ভারতের সঙ্গে বাংলার এক সাযুজ্য তৈরি করেছিল। হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি ছিল না, বাঙালি-অবাঙালি ভেদ ছিল না। সেখানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীতক গরিব মানুষের একটাই সংজ্ঞা। সেটা অর্থনীতির মাপকাঠি। ‘বাংলাবিরোধীদের বিসর্জন’ বলার কূপমণ্ডূকতাওছিল না নকশালবাড়ি লাল সেলামের সেই যুগে।

অতএব, শনিবারের পুরস্কারসন্ধ্যায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে অসীমের কথা শুনেছেন। রাষ্ট্র শুনবে, না ভীমা কোরেগাঁও মামলার ধাঁচে বিরোধীদের জেলখানায় পুরবে, একটা স্ট্র-ও দেবে কি না, সেটা অন্য কাহিনি। গণতন্ত্রের পথ বেয়ে মানুষ অক্লেশে হিংসার পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। হিমশীতল সর্পিল রাষ্ট্রযন্ত্র পারবে কি না, রাত কত হইল সেই উত্তর আজও মেলেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement