বদল: আমতা-২ ব্লকের দুই পঞ্চায়েতে এ ভাবেই নাড়া তোলা হচ্ছে নিজস্ব চিত্র।
আর কিছুদিন পর থেকেই হয়তো কালো ধোঁয়ায় ঢাকবে দুই জেলার আকাশ। পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা বাড়ছে। শুরু হয়ে যাবে নাড়া (ধান গাছের গোড়ার অবশিষ্ট অংশ) পোড়ানো। বহু চেষ্টাতেও যা রোখা যায়নি। কিন্তু নাড়া না-পুড়িয়েও সেটা যে জমির উর্বরতায় ব্যবহার করা যায়, দু’বছর ধরে সেটাই করে দেখাচ্ছেন আমতা-২ ব্লকের দুই পঞ্চায়েতের চাষিরা। রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ।
কী ভাবে?
আমতা-২ ব্লকের ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান এবং ভাটোরা— এ সময়ে এই দুই পঞ্চায়েতে গেলেই দেখা যাবে, চাষিরা নাড়াগুলিকে তুলে জমির একপাশে জমা করছেন। তাঁরা জানান, পরের বর্ষা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করবেন। তাতে জলে ভিজে গাছের অবশিষ্টাংশ নরম হয়ে যাবে। সেগুলি তাঁরা ফের জমিতে মিশিয়ে দেবেন। এতে যেমন পরিবেশ দূষণ হয় না, অন্য দিকে জমির উর্বরাশক্তি বেড়ে যায় বলে তাঁদের দাবি।
নাড়া নষ্ট করে না-ফেললে পরবর্তী আলু বা অন্য চাষ করা যায় না। সেই কারণে বেশির ভাগ চাষিই যন্ত্রে ধান কাটার পরে নাড়া জমিতে পুড়িয়ে ফেলেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রতি বছরই দুই জেলায় ধানখেত থেকে নাড়া পোড়ার কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। যা দূষিত করে পরিবেশকে।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, এক কুইন্টাল নাড়া পোড়ানোর ফলে ১৪৬০ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড, ৬০ কেজি কার্বন মনোক্সাইড, ২ কেজি সালফার-ডাই অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয়ে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ করে। সেই কারণে দফতর থেকে নাড়া পোড়ানো ঠেকাতে চাষিদের নিয়ে এই সময়ে সচেতনতা শিবির করা হয়। বিকল্প উপায় বাতলে দেওয়া হয়। যেমন— যন্ত্রের সাহায্যে ধান কেটে নেওয়ার পরে সেই যন্ত্র আবার চালিয়ে নাড়াগুলি উপড়ে ফেলে কুঁচি কুঁচি করে জমিতেই মিশিয়ে দেওয়া। অথবা, অন্য একটি যন্ত্রের মাধ্যমে নাড়াগুলি তুলে তা রুটির মতো বেলে কাগজকলে বিক্রি করা। তাতে চাষিরা অতিরিক্ত আয় করতে পারেন।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি প্রতি বছরই দুই জেলায় নাড়া পোড়ানোর কালো ধোঁয়ার চেনা ছবি এটাই। নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু দু’টি পদ্ধতিই এখনও চাষিদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। চাষিদের বক্তব্য. এতে অতিরিক্ত খরচ হয়। ধান চাষের খরচ এমনিতেই বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা আর অতিরিক্ত খরচ করতে চান না। ফলে, নাড়া পোড়ানোও বন্ধ হয় না। প্রচলিত এই পদ্ধতির বাইরে গিয়েই ব্যতিক্রমী কাজ করছেন আমতা-২ ব্লকের ওই দুই পঞ্চায়েতের চাষিরা।
রূপনারায়ণ এবং মুণ্ডেশ্বরী দিয়ে ঘেরা ওই দুই পঞ্চায়েত এলাকা হাওড়ার ‘দ্বীপাঞ্চল’ হিসেবে পরিচিত। এখানকার সঙ্গে জেলার স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। দুই পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে ধান চাষ হয়। কোথাও নাড়া পোড়ানো হয় না বলে দুই পঞ্চায়েত সূত্রের খবর। চিৎনান গ্রামের সুশীল পাল চার বিঘা জমি চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রায় দু’বছর ধরে নাড়া পোড়ানো বন্ধ করে দিয়েছি। এর ফলে জমির ফলন বেড়েছে। পরিবেশ দূষণের কথাও তো ভাবতে হবে।’’ একই বক্তব্য ভাটোরা গ্রামের চাষি নিরঞ্জন গায়েনেরও।
ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা তথা আমতা-২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি দেলওয়ার হোসেন মিদ্দা বলেন, ‘‘আমরা চাষিদের লাগাতার সচেতন করে গিয়েছি যাতে তাঁরা নাড়া না পোড়ান। তাঁরা তা বুঝেছেন।’’ সচেতনতার কথা বলছেন ভাটোরা পঞ্চায়েতের প্রধান অশোক গায়েনও। তাঁর কথায়, ‘‘এই দ্বীপাঞ্চলে নাড়া পোড়ানোর বিপদ অনেক বেশি। কারণ দূষণ দ্বীপাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তা ছাড়া এই এলাকার মানুষদের প্রধান জীবিকা চাষাবাদ। নাড়া না পুড়িয়ে তা জমিতে মিশিয়ে দিলে জমির যে উর্বরাশক্তি বাড়ে তাতে তাঁরাই শেষ পর্যন্ত লাভবান হন।’’