প্রায় এক বছর পর শুক্রবার দুপুরে বাংলায় সভা অমিত শাহের। পিটিআই
শুক্রবার দুপুরে আসবেন। শনিবার দুপুরের আগেই চলে যাবেন। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের হলেও, বাংলায় বেশ কিছু কর্মসূচি নিয়ে আসছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বীরভূমের সিউড়িতে দলীয় কার্যালয় উদ্বোধন করবেন, কলকাতায় দুই স্তরে সাংগঠনিক বৈঠক করবেন, দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দিরে পুজোও দেবেন। কিন্তু সকলে তাকিয়ে শুক্রবার সিউড়ির জনসভা থেকে শাহ কী বলেন তার দিকে।
গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে শাহ গুজরাত এবং দিল্লির পর ‘তৃতীয় ঘর’ বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলাকে। শাসক তৃণমূল কটাক্ষ করে তাঁকে ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’-ও বলেছিল। তখন শাহের লক্ষ্য ছিল নবান্ন দখল। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ না হওয়ার পর এক বছর বাংলায় পা রাখেননি তিনি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর প্রথম তিনি আসেন ২০২২ সালের মে মাসে। ৫ মে শিলিগুড়িতে সভা করে মূলত এক বছর বাংলায় না আসার কারণই শুনিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতা নিয়ে বেশ হতাশই হয়েছিল রাজ্য বিজেপি। এর পরে ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন শাহ। বিজেপি রাজ্য দফতরে কিছু সময় কাটিয়ে পরের দিন নবান্নে পূর্বাঞ্চল পরিষদের বৈঠকে যোগ দেন। সেই হিসাবে ১১ মাস পরে রাজ্যে অমিতের কোনও রাজনৈতিক সভা। ফলে তাঁর এই সফর ঘিরে রাজ্য বিজেপির আকাঙ্ক্ষাও অনেক।
রাজ্য বিজেপি নেতারা মনে করছেন, শাহের বক্তব্যে পাঁচটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসতে পারে।
কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য
সঠিক হিসাব না দিলে কেন্দ্র টাকা দেবে না। এই কথা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা আগেই কলকাতায় এসে বলে গিয়েছেন। এর পরে রাজ্য নেতারাও সেই বুলি আউড়ে চলছেন। বাংলার শাসকদল তৃণমূল, পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই বিষয়টিই জোরের সঙ্গে প্রচারে আনতে চাইছে। ভোটে ‘জিততে না পেরে বাংলাকে ভাতে মারার চেষ্টা’ বলে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এই বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের তরফ থেকে শুক্রবার মুখ খুলতে পারেন শাহ। এমনকি এখনও পর্যন্ত রাজ্য কোন খাতে কত টাকা পেয়েছে, তার হিসাবও দিতে পারেন তিনি। বলতে পারেন, বাংলা নিয়ে কেন্দ্রের আদৌ কোনও বিমাতৃসুলভ মনোভাব নেই।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন
আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও সিএএ প্রয়োগ হয়নি। এ নিয়ে বাংলার বিজেপি জনপ্রতিনিধিদের কোথাও কোথাও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। গত ২৯ মার্চ শাহের সঙ্গে দেখা করে এই প্রসঙ্গ তোলেন বাংলার বিজেপি সাংসদরা। সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বার বার অবিলম্বে সিএএ চালুর কথা বলছেন। বিজেপি সূত্রে জানা যায়, মার্চের সাক্ষাতে শাহি-আশ্বাসবাণী পেয়েছেন তাঁরা। সূত্রের খবর, সাংসদদের শাহ বলেছিলেন, ‘‘আরও ১৫-২০ দিন অপেক্ষা করুন, তার পর দেখুন কী হয়।’’ সেই সময় পার হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার কি তা নিয়ে কিছু বলবেন শাহ?
অনুব্রত মণ্ডল ও বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ
তিহাড় জেলে রয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। তার পরেও তৃণমূল কেষ্টকে বীরভূম জেলার সভাপতি করে রেখেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, বিপুল দুর্নীতি করেছিলেন অনুব্রত। এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। তবে এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে একটি কথাও শোনা যায়নি বিজেপির প্রধান দুই নেতা মোদী বা শাহের থেকে। শুক্রবার কেষ্টর জেলাতেই সভা শাহের। রাজ্য বিজেপি আশা করছে, কেষ্ট প্রসঙ্গ তুলবেন শাহ। সেই সঙ্গে রাজ্যের অন্যান্য ‘দুর্নীতি’র কথাও উঠে আসবে তাঁর মুখে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যে যে তদন্ত চলছে, সে ব্যাপারেও মুখ খুলতে পারেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী জোট
আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে চলবে, না কি সর্বভারতীয় কোনও বিরোধী জোটের অংশ হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। একের পর এক বিজেপি বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যদিও মমতা এখনও পর্যন্ত বলে রেখেছেন, ভোটের আগে জোট নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে সকলে নিজের মতো লড়াই করে ফল প্রকাশের পরে সিদ্ধান্ত। তবে এ সবের মধ্যে জাতীয় দলের তকমা চলে যাওয়ায় কিছুটা হলেও চাপে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম-সহ বিরোধীদের ভোটের আগে বা পরে সম্ভাব্য জোট নিয়ে আক্রমণ শানাতে পারেন শাহ।
রামনবমী এবং দণ্ডি কাটানোর ঘটনা
সম্প্রতি গেরুয়া শিবিরের রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় অনভিপ্রেত কিছু বিচ্ছিন্ন অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। তা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে শাহ এ নিয়ে সুকান্ত কিংবা রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে কথা বলেছেন। নবান্নকে চিঠিও পাঠিয়েছে শাহের মন্ত্রক। যে শহরে শুক্রবার শাহ সভা করবেন, সেখানে এ বছর কিছু না ঘটলেও অতীতে রামনবমীকে কেন্দ্র করে অশান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সে প্রসঙ্গ টানতে পারেন শাহ। আবার রাজ্য বিজেপিরই অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসাবে প্রসঙ্গ তুললেও সে ভাবে আক্রমণাত্মক কিছু বলবেন না শাহ। রাজ্যে বিজেপি সেই সময়ে রাজ্যে ৩৫৫ অনুচ্ছেদ জারির যে দাবি তুলেছিল, তা নিয়েও মুখ খুলবেন না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে বালুরঘাটের চার আদিবাসী মহিলাকে দণ্ডি কাটানো নিয়ে আক্রমণ শানাতে পারেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত, যে বীরভূম লোকসভা আসনে শাহ আসছেন, সেখানে দু’টি সংরক্ষিত বিধানসভা এলাকা রয়েছে। শাহের কথায় জনজাতিদের প্রতি তৃণমূলের অশ্রদ্ধার অভিযোগ উঠে আসতে পারে। টানতে পারেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থন না দেওয়ার কথাও।
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কিছু বলবেন না? রাজ্য বিজেপি নেতারা বলছেন, বাংলার পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। শাহের এই সফরের লক্ষ্য আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি। তা ছাড়া, বাংলার গ্রামীণ ভোট বাংলার নেতারা এবং দিল্লি থেকে পাঠানো পর্যবেক্ষকরাই সামলে নিন— এমনটাই চান মোদী, শাহ, নড্ডারা। তবে এটাও রাজ্য বিজেপির আশা যে, সব মিলিয়ে শাহ যা যা বলবেন তার সবটাতেই থাকবে বাংলার জ্বলন্ত সমস্যার কথা। আর তার সবটাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ইস্যু হবে।