মিলে গিয়েছে তাঁর করা একের পর এক ভবিষ্যদ্বাণী। তাঁর মুখের কথা নাকি একবারে অব্যর্থ। ফরাসি দার্শনিক তথা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নস্ট্রাদামুসের সঙ্গে উচ্চারিত হয় বুলগেরিয়ার ‘বাবা ভাঙ্গা’র নাম। একের পর এক শোরগোল ফেলা সব ভবিষ্যদ্বাণী করে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে। মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের জন্যে রেখে গিয়েছেন অনেক ভবিষ্যদ্বাণী।
ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় হারিয়ে ছিলেন দু’চোখের দৃষ্টি। তা সত্ত্বেও ‘দিব্যদৃষ্টি’ দিয়ে একের পর এক ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছে তাঁর মুখে। তিনি বাবা ভাঙ্গা। তাঁর ভবিষ্যদ্বাবাণীগুলির মধ্যে অনেক সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর পতনের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস অতিমারি, সবই নাকি জানিয়ে গিয়েছেন তিনি।
২০২৫ সালের শুরুতেই হবে এক ভূমিকম্প, এমন আভাস দিয়ে গিয়েছেন বাবা। এই বছর থেকেই যে পৃথিবীর শেষের সূচনা হতে চলেছে তারও আগাম ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন তিনি। তবে ৫০৭৯ সাল পর্যন্ত মানব সভ্যতা সম্পূর্ণ বিলুপ্তির মুখোমুখি হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
সবচেয়ে সুপরিচিত ভবিষ্যৎ-কথকের মধ্যে এক জন ছিলেন বাবা ভাঙ্গা। তিনি মারা যাওয়ার আগে যে সমস্ত কথা বলে গিয়েছেন, তা নিয়ে এখনও হতে থাকে চর্চা। একই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে কে এই বাবা ভাঙ্গা? তাঁর এই অদ্ভুত নামের রহস্যই বা কী? তিনি নারী না পুরুষ সেই নিয়েও কৌতূহল রয়েছে অনেকের মধ্যে।
‘বুলগেরিয়ার নস্ট্রাদামুস’ নামে পরিচিত এই রহস্য মোড়া ব্যক্তিত্ব আসল এক জন নারী। বাবা ভাঙ্গা নামে সারা বিশ্বে খ্যাতি ও প্রচার পেলেও এটি তাঁর আসল নাম নয়। পিতৃদত্ত নামটি হল ভ্যানগেলিয়া প্যানদেভা দিমিত্রোভা।
বাবা ভাঙ্গা নামটি তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল কী ভাবে? বাবা কথাটি শুনলে আমাদের মাথায় আসে হিন্দি বা বাংলা ভাষার কথা। বাবা ভাঙ্গার ‘বাবা’ শব্দটির সঙ্গে হিন্দি বা বাংলার বাবা শব্দের কোনও সম্পর্ক নেই।
বাবা ভাঙ্গা নামটির বুলগেরিয়ান ভাষায় যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। ‘বাবা’ শব্দটি একটি বুলগেরিয়ান শব্দ যার অর্থ ‘বয়স্ক মহিলা’ বা ‘ঠাকুমা’। বয়স্ক মহিলাদের স্নেহ এবং সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করতে ব্যবহার করা হয় শব্দটি।
১৯১১ সালের ৩১ জানুয়ারি উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্ট্রোমিকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিয়ের পর অবশ্য নাম পরিবর্তন করে তাঁর পরিচয় হয় ভ্যানগেলিয়া গুস্টেরোভা নামে। জীবনের অর্ধেকটাই তাঁর কেটেছে বুলগেরিয়ার কুজহু পার্বত্য অঞ্চলের রুপিটিতে।
খুব ছোটবেলায় তাঁর মা মারা যান। তাঁর পূর্ণবয়সের যে ছবি দেখতে পাওয়া যায় তাতে দেখা গিয়েছে, ভ্যানগেলিয়ার চোখের মণির জায়গা ফাঁকা। অথচ ছোটবেলায় সেই জায়গায় ছিল সুন্দর দু’টি নীল চোখ। আর পাঁচটি ফুটফুটে শিশুর মতো ছিলেন তিনি।
শৈশবেই মা মারা যাওয়ায় তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং তিনি তাঁর সৎমায়ের কাছে মানুষ হন। যদিও তিনি অধিকাংশ সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গেই কাটাতেন। কথিত আছে, ছোটবেলা থেকেই তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে মাঠে খেলা করে সময় কাটাতেন।
সেই সময় একটি দুর্যোগের কবলে পড়েন। ঝড়ের মধ্যে পড়ে দু’দিন নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাঁকে উদ্ধার করা হলে দেখা যায় বালি ও কাদা ঢুকে চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা হয়নি তাঁর। ফলে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান বাবা।
১৯২৫ সালে জেমুন শহরে ভাঙ্গাকে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয় যেখানে তিনি ব্রেল পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখেন। সেখানেই তিনি পিয়ানো বাজানো, সেলাই, রান্না করা শিখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হন। সে সময় যদিও চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, খুব শীঘ্রই তিনি মারা যাবেন। কিন্তু তিনি হঠাৎই সুস্থ হয়ে উঠেন।
তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা জনপ্রিয় হতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। সেই সময় অনেকেই বাবা ভাঙ্গার কাছে এসে জানতে চাইতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁদের পরিবারের সদস্যেরা বেঁচে আছেন কিনা! এই সময়ই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় দিমিতার গোসতারভ নামে একজন সৈনিকের। তিনিও ভবিষ্যৎ জানতে বাবার কাছে আসতেন।
১৯৪২ সালে দিমিতারের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর সংসার পাতেন পেটরিচে। তখন থেকে খ্যাতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এই ভবিষ্যৎ-কথকের। ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল বুলগেরীয় শাসক তৃতীয় বোরিস এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। শোনা যায়, বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কয়েক জন নেতার উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করেছিলেন বাবা ভাঙ্গা।
১৯৯৬ সালের ১১ অগস্ট স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। নিজের ভবিষ্যদ্বাণীও নিজেই করেছিলেন এই রহস্যময়ী নারী। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর দিনক্ষণ মিলিয়ে দিয়েছিলেন। মিলিয়ে দিয়েছিলেন ৯/১১-এ নিউ ইয়র্কের সন্ত্রাসবাদী হামলাও। এমনকি, চেরনোবিল বিপর্যয় এবং ব্রেক্সিটের মতো আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও যা বলেছিলেন, অলৌকিক ভাবে মিলে গিয়েছে সব।
তিনি মারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন, ২০২৫ সালে ইউরোপে একটি উল্লেখযোগ্য সংঘাত দেখা দেবে। এর ফলে ইউরোপের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাবে। ২০৪৩ সালের মধ্যে মুসলিম শাসন ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করবে। ২০৭৬ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট শাসন পুনরায় কায়েম হবে বলে জানিয়ে গিয়েছেন তিনি।