আবহাওয়ার এ হেন আচরণে ক্ষতির মুখে রাজ্যের চাষবাস।
বর্ষাকাল। ভরা শ্রাবণ। মুষলধারে বৃষ্টি চলছে। চরাচর দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েক বছর দক্ষিণবঙ্গে এ দৃশ্য কমই দেখা গিয়েছে। আর এ বছর তো প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় এখন শ্রাবণ নাকি শরত্কাল, তা বোঝা দায়। মৌসম ভবনের হিসাব বলছে, ১ জুন থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত রাজ্যে বৃষ্টির ঘাটতির পরিমাণ ৩৯ শতাংশ। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যম্ত বৃষ্টির ৪৬ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
আবহাওয়ার এ হেন আচরণে ক্ষতির মুখে রাজ্যের চাষবাস। এই কম বর্ষণ মূলত প্রভাব ফেলছে ধান চাষে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, হুগলি, দুই মেদিনীপুরে এখন আমন ধান চাষের সময়। এ ছাড়াও নদিয়া, হাওড়া-সহ দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই খরিফ চাষের মরসুম এই বর্ষাকাল। অপর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে আমন চাষে এবং খরিফ ফসল মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজ্য কৃযি দফতর সূত্রের খবর, চলতি মরসুমে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ শতাংশও এখনও পূরণ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কৃষি দফতরের আধিকারিকদের আশঙ্কা, ১৫ অগাস্টের মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে এবছর আমন ধান চাষের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে চরম বিপাকে পড়বেন ধানচাষিরা। প্রভাব পড়বে চালের খুচরো বাজারেও।
বৃষ্টি না হওয়ায় নাজেহাল অবস্থা দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের।
ভরা বর্ষাতেও বৃষ্টির অপ্রতুলতায় সঙ্কটে রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ পূর্ব বর্ধমানের চাষিরা। এক দিকে বৃষ্টি নেই, অন্য দিকে ডিভিসির দুর্গাপুরের জলাধারে বৃষ্টির অভাবে জল রয়েছে পরিমাণের চেয়ে বেশ কম। তাই সেচখালগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ছাড়তে পারছেন না ডিভিসি কর্তৃপক্ষ। ফলে কৃষকদের সমস্যা আরও বেড়েছে। জেলার নওয়াদা গ্রামের কৃষক অশোক ঘোষের কথায়, “কী হবে জানি না! এখনও জলের অভাবে জমিতে বীজ রোয়ার কাজ শুরু করা যায়নি। সেচখালেও ঠিক মতো জল না আসায় চাষিরা জাঁতাকলে পড়েছেন।” সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে জমিতে রোয়ার কাজ করতে গিয়েও বিপাকে পড়ছেন কৃষকরা। শুরু থেকেই বেড়ে যাচ্ছে খরচের বোঝা। অগস্টের প্রথম সপ্তাহ হয়ে গেলেও জমিতে জল নেই। কী করে চাষ হবে? সমস্যা জেলার উত্তর থেকে পূর্ব— সব জায়গাতেই। অন্য বছরে এই সময়ে আমন ধান রোয়ার কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়। আর এ বছর জলের অভাবে চাষিরা কাজ শুরুই করতে পারেননি। তাঁদের বক্তব্য, সেচখালে দু’দিন জল আসার পর তা বার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে রোয়ার কাজ শুরুই করা যায়নি। পূর্ব বর্ধমানের জেলা সহ কৃষি আধিকারিক আশিসকুমার বারুইয়ের বক্তব্য, “গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪৯ শতাংশ জমিতে রোয়ার কাজ হয়েছে। গত বছর এই সময়ে জেলায় ২ লক্ষ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে রোয়ার কাজ হয়েছিল। কিন্তু এ বছর এখনও পর্যন্ত রোয়া হয়েছে ১ লক্ষ ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে।”
প্যাচপেচে গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। প্রতীকী ছবি।
জলের অভাবে কোনও চাষবাসই হচ্ছে না। পোলবার ধান চাষি গণেশ রায় আত্মহত্যা কথাও ভাবছেন। তিনি সরাসরিই বলেছেন, “আমরা যারা শুধুমাত্র ধান চাষের উপর নির্ভরশীল, বৃষ্টি না হওয়ায় তারা ডুবে যাচ্ছি। এখনও রোয়ার কাজ শুরু করতে পারিনি। বীজ সব শুকিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ঘরের টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করতে হবে। তখন আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।”
একই চিত্র রাজ্যের ধানের ‘ভাণ্ডার’ হুগলি জেলাতেও। বৃষ্টি নেই। সব জমি শুকিয়ে পড়ে রয়েছে। ধানচাষ তো দূরের কথা, সব্জিও শুকিয়ে গিয়েছে।বৃষ্টির ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্য সরকারও। আনন্দবাজার অনলাইনকে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চাষের হাল খুবই খারাপ ছিল। গত কয়েক দিনে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।” বৃষ্টি না হওয়ার পাশাপাশি তিনি ডিভিসির দিকেও আঙুল তুলেছেন। তাঁর দাবি, “দুর্গাপুরের জলাধার থেকে সেচের জন্য ক্যানালে জল ছাড়ছে না ডিভিসি।” যদিও তিনি এ কথাও বলেছেন যে, “ঝাড়খণ্ড-বিহারে কম বর্ষণ হওয়ায় ডিভিসির জলাধারেও পর্যাপ্ত জল কম।” মন্ত্রী জানিয়েছেন, চাষিদের সুবিধার্থে কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে বিদ্যুত্ দফতরকে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে এ বছর চাষের মরসুমে সাবমার্সিবল পাম্প চালানোর জন্য অল্প খরচে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হয়।
কিন্তু এ বছর বর্ষণ এত কম কেন? আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাসের বক্তব্য, “রাজ্যে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় আছে। কিন্তু ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির জন্য শুধু মৌসুমি বায়ু হলেই চলে না। তার সঙ্গে নিম্নচাপেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ বছর সে ভাবে নিম্নচাপ তৈরি হয়নি।” যদিও পাশাপাশি আশার কথাও শুনিয়েছেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা। তিনি জানিয়েছেন, আগামী ৭-৮ তারিখ নাগাদ বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৯ থেকে ১১ তারিখের মধ্যে ভারি বর্ষণ হলেও হতে পারে।