ড্রোন থেকে তোলা মিছিলের বিভিন্ন মুহূর্ত এবং মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
দল সরকারে নেই নয়-নয় করে ১৩ বছর হতে চলল। বিভিন্ন জেলার সিপিএমে দীর্ঘ হচ্ছে অনটনের ছায়া। তার মধ্যেও ‘আকাশ ছোঁওয়া’র স্বপ্ন দেখেছিলেন যাদবপুর অঞ্চলের সিপিএমের যুবরা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িতও করলেন তাঁরা। শুক্রবার গড়িয়া মিতালি সঙ্ঘের মাঠ থেকে যাদবপুর এইটবি বাস টার্মিনাস পর্যন্ত ইনসাফ যাত্রার সমাপ্তি মিছিলের ছবি তোলা হল ড্রোন ভাড়া করে। পেশাদারি কায়দায় সামাজিক মাধ্যমে সমাপ্তি মিছিলের ‘লাইভ কভারেজ’ করতে উদ্যোগী হয়েছিল সিপিএমের যুব সংগঠন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেই অর্থের সংস্থান ছিল না। ফেসবুকে পোস্ট করে রাতারাতি সেই টাকা জোগাড় করে আকাশ থেকে ছবি তুলে নিজেদের ‘শক্তি’ দেখাল তারা।
একটি ছোট ম্যাটাডোর রাখা হয়েছিল। তাতে ছিল একটি আধুনিক ক্যামেরা এবং খানকয়েক ড্রোন। ডিওয়াইএফআই যাদবপুর আঞ্চলিক কমিটির নেতা অবিন দত্তগুপ্ত বললেন, ‘‘গোটাটা করতে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। যে হেতু আমাদের এলাকায় যাত্রা শেষ হচ্ছে, সভা হবে এবং অনেকের রাতে খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, তাই এ সবের টাকা আর ছিল না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছিলাম অর্থ জোগাড় করার। গত কাল সামাজিক মাধ্যমেই সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে আবেদন করেছিলাম। ছ’ঘণ্টার মধ্যে সেই টাকা আমরা জোগাড় করতে পেরেছি।’’ অবিন আরও জানান, মিছিল এবং সভার সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে ২০টি ফেসবুক পেজে।
শুক্রবার গড়িয়া থেকে যাদবপুরমুখী ইনসাফ যাত্রা। —সংগৃহীত।
গত নভেম্বরে সিপিএম রাজ্য দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনের পর ঘরোয়া আলোচনায় দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছিলেন, ‘‘আমাদের তো আইপ্যাকের মতো সংস্থা ভাড়া করার সাধ্য নেই। যতটুকু পারা যায় নিজেদেরই করতে হবে।’’ সেলিমের সেই কথা যাদবপুরের যুবনেতাদের কানে গিয়েছিল কি না জানা নেই, তবে তাঁরা নিজেদের উদ্যোগেই প্রযুক্তিগত আয়োজন করেছিলেন শুক্রবার। ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই, অনুষ্ঠানে ভিড় দেখাতে গায়ক-গায়িকারাও ড্রোন ব্যবহার করছেন। উদ্দেশ্য, সামাজিক মাধ্যমে ভিড় জানান দেওয়া। সিপিএমের যুব অংশও সেই পথেই হাঁটল।
শুক্রবার ছিল ইনসাফ যাত্রার ৫০তম এবং শেষ দিন। সকালে বারুইপুর থেকে যাত্রা শুরু হয়ে এসে থামে গড়িয়া মিতালি সঙ্ঘের মাঠে। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ হয়। সন্ধ্যার পরে শুরু হয় যাদবপুরমুখী মিছিল। মিছিলে যেমন ‘রং’ ছিল, তেমনই তা আড়ে-বহরেও চোখ টেনেছে। গড়িয়া থেকে যাদবপুর পর্যন্ত কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। অফিসফেরতা জনগণকে বিস্তর ভোগান্তির মধ্যেও পড়তে হয় শুক্রসন্ধ্যায়। তবে যে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিরই পরিচিত ‘সাফল্য সূচক’ হল জনতার ভোগান্তি। আমজনতার দুর্ভোগ যত, কর্মসূচির সাফল্য তত। নেতিবাচক হলেও আলোচনা তো হল!
তবে সবটাই ‘নেতি’ নয়। কিছু ‘ইতি’ও ছিল। রাস্তার দু’পাশে বহু মানুষকে মিছিল দেখার জন্য অপেক্ষা করতেও দেখা গিয়েছে। রাজা এসসি মল্লিক রোডের একটি দোকানের কর্মচারী ৬৫ বছর বয়সি বিশ্বনাথ নস্কর। বাড়ি নরেন্দ্রপুরে। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএমের ভরা সময়েও যুব সংগঠনের ডাকে এত বড় মিছিল দেখিনি এই এলাকায়।’’ মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ছবি মোবাইলে তুলে রাখার জন্য হুড়োহুড়িও নজরে পড়েছে। তবে মিনাক্ষীর জনপ্রিয়তার ‘গুঁতো’য় অনেক প্রবীণ সিপিএম নেতাকেও কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে মিছিলে ‘কোণঠাসা’ হতে হয়েছে। এ সবের মধ্যেও সিপিএমের গোষ্ঠীকোন্দল অনেকেরই চোখ এড়ায়নি। গড়িয়া মোড়ে যে মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল, তার ‘নিয়ন্ত্রণ’ দলের কোন অংশের হাতে থাকবে, তা নিয়ে চাপা লড়াই ছিল। শুক্রবার তা চাক্ষুষও করা গিয়েছে। তবে অনেক নেতার শুক্রবারের উপলব্ধি— একদা যাঁদের প্রতাপ দোর্দণ্ড ছিল, নতুন প্রজন্ম তাঁদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। মিছিলের সামনে চলে আসায় যে ভাবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একদা ‘ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন’ নেতাকে ধাক্কা খেয়ে সরে যেতে হল, তা তিনি কেন, অনেকেরই কল্পনাতীত ছিল।
তবে মিছিলের মধ্যেও ফিসফাস চলল— ভিড় হল। ভোট হবে কি?