(বাঁ দিকে) বিমান বসু। মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
১৯৮২ সালের গোড়ায় পুরুলিয়ার হুড়া থেকে পদযাত্রা করেছিলেন কলকাতা পর্যন্ত। সাত দিনে হেঁটেছিলেন ২০০ কিলোমিটারের বেশি।
১৯৮৪ সালে কোচবিহার থেকে কলকাতা পদযাত্রা করেছিলেন টানা ২৬ দিন ধরে। ১,১০০ কিলোমিটারের বেশি।
২০০৮ সালে চন্দ্রকোণা থেকে কেশপুর পদযাত্রা করেছিলেন। তিন দিনে ৩২ কিলোমিটার।
তিনটি যাত্রারই পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। তিনটি যাত্রার সময়ে কখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জ্যোতি বসু, কখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মাথার উপরে বামফ্রন্ট সরকার। তিনি— বিমান বসু। বয়স— ৮৩ বছর। শুক্রবার শেষ হচ্ছে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ইনসাফ যাত্রা। তার আগে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়দের হাঁটায় নম্বর দিলেন বাংলার রাজনীতিতে ‘হন্টনের হেডমাস্টার’।
সিপিএমের রাজ্য দফতরে বসে নিজের পদযাত্রার কথা বলতে গিয়ে প্রথমে উল্লিখিত তিনটিকে সবচেয়ে উপরে রাখলেন তিনি। তাঁর দলেরই যুব সংগঠন গত ৩ নভেম্বর কোচবিহার থেকে পদযাত্রা শুরু করেছিল। পোশাকি নাম ইনসাফ যাত্রা। যা শেষ হবে শুক্রবার বিকেলে। রাজ্যের সব জেলা ছুঁয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে শুক্রবার যাত্রার শেষে সভা যাদবপুরে। যে যাত্রা পেরিয়েছে ১৩০০ কিলোমিটার পথ। গোটা রাস্তাটা হেঁটেছেন যুব সম্পাদক মিনাক্ষী, সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহারা। টানা। অবিরাম। মাথার উপর সরকার নেই। দলের সেই শক্তিও নেই। অথচ মিনাক্ষীদের ইনসাফ যাত্রা ঘিরে সাড়া পড়েছে। যা খানিকটা অপ্রত্যাশিত তো বটেই। বিমানও তো মেনে নিলেন, তাঁর পদযাত্রার সময়ে রাজনৈতিক অবস্থার তুলনায় এখন বামেদের অবস্থা সব দিক থেকেই প্রতিকূল। সেই নিরিখে বিমান কত নম্বর দেবেন মিনাক্ষীদের? অশীতিপর বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের একবাক্যে উত্তর, ‘‘মিনাক্ষীদের ১০০-য় ১০০ দেব!’’ তবে বর্ষীয়ান নেতা এ-ও মেনে নিয়েছেন, এই যাত্রার সঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যদিও সিপিএমের অনেক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, মিনাক্ষীর নামে অনেক ঘরে ঢুকে যাওয়া কর্মীও রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন। যা সংগঠনের দিক থেকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
বিমানের রাজনৈতিক জীবনে পদযাত্রা ‘ইউএসপি’। অনেক তরুণ নেতাও হাঁটার ব্যাপারে তাঁকে সমঝে চলেন। কারণ, বয়সে ৮০ পেরোনো বৃদ্ধ এখনও হাঁটায় বলে-বলে গোল দিতে পারেন অনুজদের। তবে ইদানীং আর তা পারছেন না। কয়েক মাস আগে হুগলির একটি পদযাত্রায় ৩৪ মিনিট হেঁটে থেমে গিয়েছিলেন বিমান। অথচ দু’বছর আগেও আরামবাগ থেকে গোঘাট হেঁটে গিয়েছিলেন গটগট করে।
পদযাত্রা কেন তাঁর প্রিয়? বিমান জানালেন, হাঁটতে বেরিয়ে তিনি গান্ধীজিকে অনুসরণ করেন। ডান্ডি অভিযান, লবণ সত্যাগ্রহের কথা উল্লেখ করলেন। হাঁটতে হাঁটতে মিনাক্ষীদের পায়ের পাতা ফেটে রক্ত বেরোনোর ছবি সিপিএম সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। যদিও দেখা গিয়েছে, তাঁরা পায়ে স্পোর্টস স্নিকার্স পরে হাঁটছেন। তাঁর পায়েও কি এমনই কোনও জুতো থাকত? বিমানের সাফ জবাব, ‘‘ওসব আমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই! এখন পায়ে যে চটিটা পরে আছি, সেটার দাম ২৪৬ টাকা!’’
তবে এ কথা ঠিক যে, ইনসাফ যাত্রায় মিনাক্ষীকে নিয়ে একটা উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। সিপিএমের নিচুতলার অনেকে তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করা শুরু করেছেন। স্বয়ং রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, ‘‘মানুষ যদি মিনাক্ষীকে মুখ করে নেন, তা হলে আমরা কী করতে পারি?’’ এই উচ্ছ্বাসকে বিমান কী চোখে দেখছেন? প্রবীণ নেতার এ বার আরও সটান জবাব, ‘‘মিনাক্ষীকে ঘিরে মানুষ যে ভাবে উদ্বেল হচ্ছেন, এমন আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে দেখিনি।’’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীদের (ষাটের দশকের বাম ছাত্র আন্দোলনে সুভাষ-শ্যামল ছিলেন জুটি) ক্ষেত্রেও নয়? বিমানের সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট জবাব, ‘‘না। মিনাক্ষীকে নিয়ে যা হচ্ছে, এ রকম না।’’
কেন এই উচ্ছ্বাস? এই উন্মাদনা? বিমান শোনালেন নিজের অভিজ্ঞতা, ‘‘কয়েক মাস আগে দলের কর্মসূচিতে একটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে একজনের বাড়িতে উঠেছিলাম। সেই বাড়ির লোকজন আমায় মিনাক্ষী নিয়েই যাবতীয় প্রশ্ন করে গেলেন। মিনাক্ষী কোথা থেকে জামাকাপড় কেনে থেকে শুরু করে নানাবিধ প্রশ্ন। আমার মনে হয় মিনাক্ষীর ইনোসেন্ট মুখ, মেঠো কথা ওকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলছে।’’
সিপিএমের এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশে কি রুপোলি রেখা দেখা যাচ্ছে? ‘হন্টনের হেডমাস্টার’ একমত। সাধে কি ১০০-য় ১০০ দিয়েছেন!