ছবি: এএফপি।
কোভিড ভাইরাসের দাপট রোধে পুজো মণ্ডপ দর্শনার্থী শূন্য করার জন্য কী করতে হবে তা সোমবার বলে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য মঙ্গলবার আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব কমিটি’। যার প্রেক্ষিতে চিকিৎসক সংগঠন-সহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, পুজো কমিটিদের একাংশ কেন বুঝতে চাইছেন না ভিড় মানেই উৎসব নয়, তবে সংক্রমণ নিশ্চয়!
এই বক্তব্যের পাশেই রয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এদিনের করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যান। চতুর্থীতে বঙ্গে একদিনে সংক্রমণের সংখ্যা চার হাজারের (৪০২৯) গন্ডি অতিক্রম করেছে। উৎসবের ভিড়ের হাত ধরে প্রতিদিন চার হাজারের আক্রান্তের পরিসংখ্যান কীভাবে দ্বিগুণ হয় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল কেরল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভাইরাসকে হয়তো খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু পুজোর আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে সরকারি বুলেটিনের পরিসংখ্যানকে কীভাবে অস্বীকার করা যায়। এদিন উত্তর ২৪ পরগনায় ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা নশোর (৮৭১) কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। কলকাতায় দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ৮০৯ জন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা (২২৫), হুগলি (২৪৭), হাওড়া (২১১), পশ্চিম মেদিনীপুরের (২২৪) অবস্থাও ভাল নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আট মাসেও যাঁরা সংক্রমিত হননি তাঁরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝছেন না কোভিডের মতো ছোঁয়াচে রোগ এই অসেচনতার অপেক্ষাতেই বসে থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রীতম রায় বলেন, ‘‘পুজো মণ্ডপে ঢুকতে না পারলে অনেকে বাড়ির বাইরে বেরোতে উৎসাহিত হবেন না, এই ভাবনা থেকে মণ্ডপ দর্শনার্থী শূন্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুজো কমিটিগুলি এই পর্যবেক্ষণকে মেনে নিলে হাসপাতালগুলির উপরে রোগীর চাপ কমানোর প্রশ্নে পরোক্ষভাবে তাদের অনস্বীকার্য আবেদন থাকবে।’’ সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে হাসপাতালগুলির এখনকার পরিস্থিতির কথা টেনে ‘ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনে’র সেক্রেটারি জেনারেল সংঘমিত্রা ঘোষ জানান, বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। মূলত মাঝারি এবং গুরুতর অসুস্থ রোগীদেরই ভর্তি করা হচ্ছে। তবুও রোগীর চাপ চতুর্থীতেই সামলানো যাচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘পুজো উপভোগ করতে যাঁরা রাস্তায় বেরিয়েছেন তাঁদের কিছু হবে না। কিন্তু তাঁরা বাড়ির বয়স্ক মানুষকে সেই রোগ উপহার দেবেন।’’ অসুস্থদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে তা বোঝাতে পিয়ারলেসের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার সুদীপ্ত মৈত্র জানান, সম্প্রতি একশো থেকে বেডের সংখ্যা দেড়শো করার পরও চতুর্থীর সন্ধ্যায় একটিও শয্যা নেই। হাতের পাঁচ যে কুড়িটি শয্যা সেখানে রয়েছে তা-ও ভর্তি হতে শুরু করেছে। সুদীপ্তবাবুর বক্তব্য, ‘‘নন কোভিড রোগীদের ওয়ার্ড থেকে আরও বেড বাড়ানো হবে। কিন্তু নার্স কোথায়? নন-কোভিড রোগীদরেও তো চাপ রয়েছে। এখনও বহির্বিভাগে চারশোর উপরে রোগী আসছেন। কোনও বার পুজোর সময় এরকম পরিস্থিতি হয়নি।’’
আরও পড়ুন: শখ করে রোগ না-বাধিয়ে আমাকে দেখুন
আরও পড়ুন: আজ নজর আদালতে, মণ্ডপে বাড়তি বাহিনী, ড্রোনও
ভিড় নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে এদিন বেশ কয়েকটি পুজো মণ্ডপে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ‘প্রোটেক্ট দ্য ওয়ারিয়র্সে’র সদস্যেরা। সেই সদস্য দলের চিকিৎসকদের একাংশ জানান, হাইকোর্টের রায় মানার ক্ষেত্রে পুজো কমিটিদের একাংশের বক্তব্য, শেষ মুহূর্তে এই নির্দেশ মেনে চলার কিছু বাস্তবিক সমস্যা রয়েছে। যার প্রেক্ষিতে চিকিৎসক দলের পাল্টা বক্তব্য, সন্তোষপুরের একটি পুজো কমিটি এমন ভাবে প্যান্ডেল তৈরি করেছে যাতে দূর থেকেই দর্শনার্থীরা তা দেখতে পারবেন। ভিতরে ঢোকার প্রয়োজন নেই। বালিগঞ্জের পরিচিত পুজো কমিটিও মণ্ডপে যাতে কুড়ি জনের বেশি না থাকেন তা নিশ্চিত করেছে। উল্টো দিকে রাসবিহারী, সল্টলেক, লেকটাউন-সহ বেশ কিছু বড় পুজো কমিটির আয়োজনের মধ্যেই ভিড়কে প্রশ্রয় দেওয়ার উপাদান মজুত রয়েছে। ওই সদস্য দলের এক চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘ভিড় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রথম থেকে যাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁদের অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু যাঁরা ভিড়োমিটারে শীর্ষে থাকতে চেয়েছেন তাঁদেরই সমস্যা হচ্ছে।’’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই জানান, চিকিৎসকদের বক্তব্যকে মান্যতা দিয়ে আদালত কেন এই রায় দিয়েছে তা সকলের বোঝা উচিত। হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় যুক্ত হয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম। সংগঠনের তরফ একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত আট মাস চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে ক্লান্তি কাজ করছে। এ সময়ে বিপুল সংখ্যক রোগীর চাপে স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়তে পারে। রাজ্যের করোনা বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য তথা এসএসকেএমের মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান সৌমিত্র ঘোষ বলেন, ‘‘উৎসবের নামে এমন কিছু করা যায় না যা মৃত্যুর দরজা খুলে দিতে পারে!’’
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)