মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। —ফাইল ছবি
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের পরে রবিবার পুরুলিয়া জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খোঁজ নিলেন জেলার বিভিন্ন বিষয়ে।
নজরে জল
তিন বছর আগে পুরুলিয়ায় জল সঙ্কট সমাধানের জন্য জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) টাকা দিচ্ছে না শুনে প্রশাসনিক বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার বেলগুমা পুলিশ লাইনের প্রেক্ষাগৃহে প্রশাসনিক বৈঠকে এসে জাইকা প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়ার খবর শুনে ফের অসন্তুষ্ট হলেন তিনি।
এ দিন বৈঠক শুরু হওয়ার কিছু পরেই রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউড়ি ও পাড়া কেন্দ্রের বিধায়ক উমাপদ বাউড়ি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দু’-একটি সমস্যার সঙ্গে পানীয় জলের কষ্টের কথা তোলেন। তখনই মমতা জাইকা প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, জাইকা প্রকল্পে যুক্ত আধিকারিকেরা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, বিষয়টি এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আটকে রয়েছে। সেই পর্ব মিটলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। তা শুনে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, কেন টেন্ডার করা যাচ্ছে না? পিএইচই কী করছে? যদিও জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, জাইকা প্রকল্পটি দেখাশোনা করছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের আওতায় থাকা একটি পৃথক বিভাগ।
বস্তুত পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে শীতের পরেই জলের সমস্যা শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী তাই জল সমস্যার সমাধান পাখির চোখ করেছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, ২০১৩ সালে পুরুলিয়া জেলার যে সব এলাকা পানীয় জলের সঙ্কট বেশি রয়েছে, সেই সব ব্লকে ধাপে ধাপে জল পৌঁছে দেওয়া হবে। সে জন্য রাজ্য সরকার জাইকা-র (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) সহায়তা নিতে উদ্যোগী হয়। প্রকল্পেরর প্রথম পর্যায়ে রয়েছে পুরুলিয়া ১, পুঞ্চা, বরাবাজার, মানবাজার ১, আড়শা ব্লক এবং পুরুলিয়া পুরসভা। বাকিগুলি দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ হবে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১২৯৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে কী অবস্থায় ওই প্রকল্প?
প্রশাসন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে ওই প্রকল্পের জন্য পাইপলাইন পাতার, পাম্পহাউস তৈরি এবং ওভারহেড ট্যাঙ্কের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ হয়েছে। কিন্তু টেন্ডার নিয়েই জট পাকিয়ে আছে। সূত্রের খবর, সমগ্র প্রকল্পটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী গত অক্টোবরে টেন্ডার ডাকা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে অবশ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জেলার আধিকারিকেরা বৈঠকের পরে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়া পুরসভাকে সমস্ত বাড়িতে জলের সংযোগ দিতে বলায় খুশি বাসিন্দারা। কারণ লটারিতে না জেতায় অনেকেই আবেদন করেও বাড়িতে জলের সংযোগ পাননি। এ নিয়ে পুরপ্রধান সামিমদাদ খান বলেন, ‘‘আমাদের শহরে ৪০ হাজার বাড়ি রয়েছে। আর প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে থাকা মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইরেক্টরেটের কাছ থেকে আমরা মাত্র ছ’হাজার জলের সংযোগ দেওয়ার জন্য অনুমোদন পেয়েছি। জলের যত চাহিদা তার পুরোটা এখনও সংস্থান হয়নি। তবে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে দেখছি, কী ভাবে কী করা যায়।’’
মরা ছাগল
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কাজকর্ম নিয়ে খোঁজ নেওয়ার সময়ে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি উঠে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন, ওই দফতর থেকে গরিব মানুষকে দেওয়া বিলি করা ছাগলের বাচ্চার মধ্যে মৃতের হার প্রচুর। কেন বিলি করা ছাগল বাচ্চা মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান। সূত্রের খবর, প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের আধিকারিকেরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা বিডিও-দের কথামতো স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে ছাগলের বাচ্চা নিয়ে বিলি করেন। তবে সে ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধের টিকা ঠিক মতো দেওয়া হচ্ছে কি না, সংশয় রয়েছে। তা শোনার পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, সমস্যা যদি তাই হয়, তাহলে বিষয়টি বিডিও এবং পঞ্চায়েত সমিতি দেখুক। বস্তুত গত কয়েকমাস ধরে জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বিভিন্ন গ্রামে গিয়েও বিলি করা ছাগলের বাচ্চা মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ শুনেছিলেন। তখন জেলাশাসক উপভোক্তাদের প্রাণিমিত্রদের ফোন নম্বর দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।
‘গ্রামে যাও’
মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়লেন বিধায়কেরা।
প্রশাসনিক বৈঠকের গোড়ায় কয়েক জন জনপ্রতিনিধিকে নাম ধরে ডেকে মমতা তাঁদের এলাকায় কী সমস্যা জানতে চান। প্রথমেই সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাজে কোনও সমস্যা নেই। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেখছি, উন্নয়নের কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কি না।’’ এরপরেই মমতা কাশীপুরের বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়ার কাছে জানতে চান, এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ কেমন হচ্ছে? স্বপনবাবু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অসহযোগিতার কথা উত্থাপন করা মাত্রই তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রশাসন ঠিক ভাবেই তার নিজের কাজ করছে। তুমি তোমার কাজ করো।’’
মূলত স্বপনবাবু-সহ পাড়া কেন্দ্রের কেন্দ্রের উমাপদ বাউরি ও বান্দোয়ানের বিধায়ক রাজীবলোচন সোরেনের কাছে তিনি জানতে চান, তাঁরা কি তাঁদের বিধানসভা এলাকায় ঘোরেন? মানুষের সমস্যার কথা জানতে চান? এরই ফাঁকে উমাপদবাবু দু’টি গ্রামে জলের সমস্যার কথা তুলতেই মমতা বলেন, ‘‘সরকার অনেক কাজ করেছে। তোমরা তোমাদের নিজেদের কাজ ঠিক ভাবে করো।’’
বাকি যা
একশো দিনের কাজ নিয়ে জেলাশাসক বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অভিযোগ পেয়েছেন, জেলার মাটি পাথুরে ও শক্ত হওয়ায় একটি শ্রম দিবসের পাওয়ার জন্য ৫২ ঘনফুট মাটি কাটা যাচ্ছে না। বিষয়টি তুলে জেলাশাসক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ওই মাপকাঠি ৪২ ঘনফুট করা যায় কি না তা বিবেচনার জন্য অনুরোধ রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কর্মকর্তাদের দেখতে বলেন।
জেলা সিএমওএইচ অনিলকুমার দত্তের কাছে জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চান মমতা। অনিলবাবু অযোধ্যা পাহাড়ের তেলিয়াভাসা, বলরামপুরের কেরোয়া, বান্দোয়ানের লতাপাড়ার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দীর্ঘদিন চিকিৎসক না থাকার কথা জানান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দেন।
কিছু স্কুল ভবনের পরিকাঠামোগত সমস্যার কথাও ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। দরকারে ক্লাসঘর বাড়ানো যাবে।