রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার সকালে রাজভবনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিবৃতি দিয়ে মমতা কড়া সমালোচনা করলেন রাজ্যপালের ওই উদ্যোগের। তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নন, তৃণমূলের সর্বভারতীয় চেয়ারপার্সন হিসাবে এই বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। তৃণমূলের তরফে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তির গোড়াতেই মমতার মন্তব্য, ‘‘আমার সারা জীবন বাংলায় কেটেছে। কখনও ‘রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস’-এর কথা শুনিনি।’’ এর পরে সরাসরি বিজেপিকে নিশানা করে তাঁর অভিযোগ, ‘‘এই উৎসবের উদ্দেশ্য বাংলার মাটি এবং মানুষকে অপমান করা। বিজেপি মনে করে, তারা কিছু করলেই অন্যদের সায় দিতে হবে, সেটি তাদের ভুল ভাবনা।’’ রাজ্যের অন্য দুই বিরোধী শক্তি বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসও ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ সম্পর্কে অবহিত নয় বলেও দাবি করেছেন তিনি।
রাজ্যপালকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ কর্মসূচি পালন না-করার জন্য যে তিনি সোমবার চিঠি লিখেছিলেন, সে কথাও জানাতে ভোলেননি তৃণমূলনেত্রী। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকারের প্রস্তাব সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে সায় দেয়নি কেন্দ্র। বিবৃতিতে মমতা লিখেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের জন্য আমাদের আবেদন ছ’বছরেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিচারাধীন। আমরা নাম পরিবর্তন করতে চাই, কারণ বদলির সময় আমাদের অফিসারদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বর্ণমালা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গ নামের আদ্যক্ষর ‘ডব্লিউ’ তালিকার নীচের দিকে থাকে।’’ এর পরে সরাসরি নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে নিশানা করে মমতার মন্তব্য, ‘‘বাংলার নাম পরিবর্তনে কেন্দ্রের আপত্তি আছে। কিন্তু তারাই আবার আমাদের তথাকথিত ‘প্রতিষ্ঠা দিবস’ উদ্যাপন করছে! এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কি হতে পারে?’’
প্রসঙ্গত, সোমবার ফোন করে রাজ্যপালকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন না-করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মমতা। ফোনের পাশাপাশি, রাতে নবান্ন থেকে রাজভবনে চিঠি পাঠিয়ে নিজের অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে ‘কর্ণপাত’ না-করে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি মতোই মঙ্গলবার ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করেন রাজ্যপাল বোস। এর আগে গত শনিবার রাজভবন থেকে জানানো হয়েছিল, ২০ জুন রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের আয়োজন করা হচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন রাজ্যপাল। সোমবার এই সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে রাজ্যপালকে ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে নবান্ন থেকে একটি চিঠিও পাঠানো হয় রাজভবনে। সেই চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যপালের কথপোকথনের কথাও উল্লেখ করা হয়। মমতা চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘আপনার সঙ্গে কথপোকথনের সময় আপনি সম্মত হয়েছেন যে একতরফা ভাবে এবং কোনও রকম আলোচনা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ দিবসের ঘোষণা করা ঠিক নয়। আপনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে এই ধরনের কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন আপনি করবেন না।’’
কেন রাজ্যপালকে অনুরোধ মমতার
‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের আয়োজন না-করার জন্য অনুরোধের কারণ ‘প্রসঙ্গে’ মমতা রাজ্যপালকে লিখেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর থেকে কখনও বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ দিবসের মতো কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি। দেশ বিভাজনের এই ঘটনাকে বাংলা সদাই মনে রেখেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হিসেবে।’’ তিনি আরও লেখেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জন্ম কোনও বিশেষ দিনে হয়নি। আমরা বাংলায় জন্মেছি, বড় হয়েছি। কখনও এখানে কোনও দিন পশ্চিমবঙ্গ দিবসের মতো কোনও অনুষ্ঠানে হতে দেখিনি। এই ধরনের অনুষ্ঠান কোনও রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রতিহিংসার রাজনীতির জন্য করতেই পারে, কিন্তু এই ধরনের কোনও অনুষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের কোনও যোগাযোগ নেই।’’ মমতার কথায়, ‘‘বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি অত্যন্ত উচ্চ মানের, যা নিয়ে অনেক দিনের ইতিহাস রয়েছে। বাংলা থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন হয়েছে, রেনেসাঁস হয়েছে, হয়েছে সমাজ সংস্কার। তাই আপনার দ্বারা এমন কিছু অনুষ্ঠিত হলে মানুষের মধ্যে সংশয়, অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক বিরূপতা তৈরি করতে পারে।’’ রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালিত হলে তাতে যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ও রাজ্য মন্ত্রিসভার সম্মতি থাকবে না, তা-ও বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের জন্য যদি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কোনও নির্দেশ দিয়ে থাকে, তা যে অসংবিধানিক ও এক তরফা সিদ্ধান্ত হবে তা-ও রাজ্যপালকে নিজের চিঠিতে স্পষ্ট জানান মমতা। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা উপেক্ষা করে রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের আয়োজন রাজ্যপাল-রাজ্য সরকার সংঘাত আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই রাজ্যপাল বোসের এই পদক্ষেপে খুশি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। রাজভবনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন নিয়ে রাজ্যপালকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁর ‘সমালোচক’ হিসাবে পরিচিত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। মমতা মঙ্গলবার ব্যস্ত ছিলেন কর্মসূচিতে। কলকাতার ইসকনে দড়ি টেনে রথযাত্রার সূচনা করেন তিনি। সেখানে হাজির ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী ডোনা। অন্য দিকে, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ কর্মসূচিতে না গেলেও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজভবনে গিয়েছিলেন সৌরভ।
‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের বিরোধিতায় ক্রীড়াবিদেরা
রাজভবনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের প্রতিবাদে মঙ্গলবার গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বাংলার বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের মিছিল হয়। তাতে অংশ নেন রাজ্যের বিদ্যুৎ, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ, আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ওই ধিক্কার মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তথা ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন সদস্য মনোজ তিওয়ারি। ধিক্কার মিছিল ক্রীড়াবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দিব্যেন্দু বড়ুয়া, নিমাই গোস্বামী, মানস ভট্টাচার্য, বিকাশ পাঁজি, শিবশঙ্কর পাল, রহিম নবি, দীপেন্দু বিশ্বাস, মাধব দাস, সঞ্জয় মাঝি, প্রশান্ত চক্রবর্তী। এ ছাড়াও মোহনবাগান ক্লাবের পক্ষ থেকে সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষে দেবব্রত সরকার ও শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত মহমেডান ক্লাবের পক্ষ থেকে মহম্মদ কামারউদ্দিন ও ইস্তেফাক আহমেদ রাজু এবং আইএফএ-র প্রতিনিধি হিসাবে অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরূপ বিশ্বাস এবং সৌরভ পালও ছিলেন মিছিলে।