বিজেপির সর্বোচ্চ স্তর থেকেই পরিস্থিতির রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
ধিকিধিকি আগুন অনেক দিন ধরেই জ্বলছিল দলের অন্দরে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দিল্লিতে ম্যারাথন বৈঠক চলাকালীন তা প্রায় দাবানলের চেহারা নেয়। কিন্তু যে রাজ্যকে দলের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা, সেই পশ্চিমবঙ্গে ঘরোয়া আগুনকে কিছুতেই বাড়তে না দেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নামল দিল্লি। দলে প্রত্যেকের গুরুত্ব সুনিশ্চিত করুন, প্রকাশ্য মন্তব্যে রাশ টানুন— রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে স্পষ্ট বার্তা সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার। দিল্লিতে বৈঠক সেরে মঙ্গলবার কলকাতায় ফিরে দিলীপ নিজেই সে কথা জানালেন। আর দিলীপ কলকাতায় ফিরতেই তাঁর বাড়িতে বেশ কয়েক ঘণ্টার যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক মঙ্গলবার সকালে হল, তাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার 'রোডম্যাপ' ছকে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গেল।
রাজ্য বিজেপির সামনের সারির যে নেতা এ দিন এই 'রোডম্যাপ'-এর কথা বলেছেন, তিনি নিজে বৈঠকে ছিলেন না। তবে যে কোনও মূল্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে রাশ টানার প্রক্রিয়া যে দলের অন্দরে গত কয়েক দিন ধরেই চলছিল, সে কথা বিজেপিতে কারও অজানা নয়। এক দিকে নড্ডার ডাকে দ্রুত দিলীপের দিল্লি ছুটে যাওয়া আর অন্য দিকে কলকাতায় এসে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি মুকুল রায়ের বাড়িতে কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের হাজির হওয়া, সবটাই রুটিন প্রক্রিয়া, এমনটা মানতে রাজি নন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বিজেপি নেতারাও যে খুব জোর দিয়ে তেমনটা দাবি করতে পারছেন, তা-ও নয়। অতএব, রাজ্য দলের অন্দরে তৈরি হওয়া টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হস্তক্ষেপ শুরু করলেন বলে জল্পনা তৈরি হচ্ছিল। দিলীপ ঘোষের মন্তব্যে মঙ্গলবার আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বিজেপির সর্বোচ্চ স্তর থেকেই পরিস্থিতির রাশ হাতে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
রবিবার কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গে তাঁর কোনও বৈঠক হয়নি বলে মুকুল রায় দাবি করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওই দিন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সোজা মুকুলের সল্টলেকের বাড়িতে যে কৈলাস গিয়েছিলেন, তা কারও অজানা নয়। সেখানে কৈলাস যে প্রায় ৪৫ মিনিট ছিলেন, সে কথাও মুকুলের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রেই জানা গিয়েছিল। বিজেপির একটি অংশের দাবি, এটা ড্যামেজ কন্ট্রোল প্রক্রিয়ারই একটা পর্ব। দিলীপ ঘোষকে দিল্লিতে ডেকে যে দিন নড্ডা এক ঘণ্টার বৈঠক করছেন, ঠিক সে দিনই কলকাতায় মুকুলের বাড়িতে কৈলাস প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা কাটাচ্ছেন, এই দুয়ের মাঝে কোনও সংযোগ নেই, এমনটা মানতে অনেকেই নারাজ। দলের অন্দরের অনৈক্য যে ভাবে সামনে আসতে শুরু করেছিল, তা রুখতে বিজেপি নেতৃত্ব সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছেন বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। সে অভিযান ইতিমধ্যেই ফল দিতে শুরু করেছে বলেও বিজেপি সূত্রে ইঙ্গিত মিলছে।
আরও খবর: কিষেণজির জায়গায় কিষাণ? জঙ্গলমহলে ফের বিপদসঙ্কেত পাচ্ছেন গোয়েন্দারা
যে হেতু দিলীপ আর মুকুলের মধ্যে মতানৈক্য নিয়েই সবচেয়ে বেশি জল্পনা ছড়িয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক শিবিরে, সে হেতু মুকুলের বিষয়ে দিলীপকে কোনও স্পষ্ট বার্তা নড্ডা দিয়েছেন কি না, তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। তবে দিলীপ ঘোষ মঙ্গলবার আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেন, “নড্ডাজির সঙ্গে বৈঠকে কোনও ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে মুকুল রায় সিনিয়র নেতা। তিনি একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁকে নিয়ে নিশ্চয়ই নেতৃত্বের কোনও ভাবনা রয়েছে।” কী সেই ভাবনা? দিলীপ ঘোষের কথায়, “সে কথা আমার জানা নেই। তিনি কী কাজ করবেন বা তাঁকে কী ভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই ঠিক করবেন। রাজ্য নেতৃত্বের এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। এটা রাজ্যের বিষয় নয়।”
নড্ডার সঙ্গে তা হলে কী নিয়ে আলোচনা হল? দিলীপের জবাব, “সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। আর সংবাদমাধ্যমের সামনে মন্তব্য করার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”
রাজ্য বিজেপির সভাপতি অকপটে যা জানালেন, তাতে কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত স্পষ্ট। রাজ্য বিজেপির অন্দরে যা চলছে, তা যে দলের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়, সে কথাও খুব স্পষ্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। এবং এই পরিস্থিতি কাটানোর দায়িত্ব যে সভাপতি হিসেবে দিলীপকেই নিতে হবে, সে বার্তা পরিষ্কার ভাবেই দিয়ে দিয়েছেন নড্ডা। দিলীপ ঘোষের কথাতেই তার ইঙ্গিত রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে দিলীপ ঘোষের কিছু মন্তব্য নিয়েও সম্প্রতি বিতর্ক বেড়েছিল। দলের অন্দরে সঙ্ঘাত তীব্র হয়ে ওঠার জল্পনা যখন তুঙ্গে, সে সময় দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, তাঁর কাউকে প্রয়োজন নেই, তিনি একাই নির্বাচন জিততে সক্ষম। তিনি বরাবর বুকে পা দিয়ে রাজনীতি করে এসেছেন, এমন মন্তব্যও শোনা গিয়েছিল। দিলীপের এই সব মন্তব্য নিয়ে তুমুল জলঘোলা শুরু হয়। তা হলে কি মুকুল শিবিরকে দিলীপ ঘোষ পুরোপুরি কোণঠাসা করে দেওয়ার ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন? এমন প্রশ্নও উঠে যায়। দিল্লির বৈঠকে এই সব বিষয়েই দিলীপ ঘোষকে সতর্ক করা হয়েছে বলে একাংশের মত। সংবাদমাধ্যমের সামনে মন্তব্যের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বলে দিলীপ নিজেই যে কথা জানিয়েছেন, বিশ্লেষকদের মতে তাতেই নড্ডার ওই বার্তার ইঙ্গিত রয়েছে।
আরও খবর: কলকাতার জন্য আরও ৫০টি ই-বাস কিনছে রাজ্য, ৫ মন্ত্রী-আমলার জন্য ই-কার
মুকুল রায়ের শিবির থেকেও কোনও বিরূপ মন্তব্য কিন্তু হয়নি। দিল্লিতে যে বৈঠকে তাঁর থাকার প্রয়োজন নেই বলে মুকুল জানিয়েছিলেন জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে, অগস্টে সেই বৈঠকই কলকাতায় শুরু হল। এবং দিলীপ ঘোষের বাড়িতে আয়োজিত সেই বৈঠকে মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুকুল রায় উপস্থিত থাকলেন। নতুন করে কোনও সঙ্ঘাতের খবরও আর বাইরে এল না। আগামী কয়েক দিন ধরে এই বৈঠক দিলীপের বাড়িতে চলবে। রোজ ৪-৫টি জেলা কমিটিকে ডাকা হবে। বৈঠকে দিলীপ ঘোষ, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, কৈলাস বিজয়বর্গীয়, অরবিন্দ মেননদের সঙ্গে মুকুল রায়ও থাকবেন বলে খবর। ঘরোয়া উত্তেজনা যে প্রশমিত হওয়ার পথে, এতেই তার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
জেলাগুলিকে নিয়ে বৈঠক শুরুর আগে মঙ্গলবার সকালে কিন্তু রাজ্য বিজেপির তিন শীর্ষ নেতা এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুই প্রতিনিধি আলাদা করে কথাবার্তা সেরে নেন বলে খবর। দিল্লির বার্তা বিবদমান দু’পক্ষের কাছেই ছিল। দিল্লির প্রতিনিধি কৈলাস এবং মেননও উপস্থিত ছিলেন। কোনও অশান্তি যাতে আর না থাকে, সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি যাতে আর কিছুতেই তৈরি না হয়, সকালের বৈঠকে প্রথমে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। তার পরে শুরু হয়েছে জেলাগুলিকে নিয়ে বৈঠক। তবে দিল্লি থেকে কলকাতা পর্যন্ত সাঁড়াশি তৎপরতার কারণে বিজেপির অন্দরের আগুন আপাতত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে বলেই ইঙ্গিত।