গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মন্ত্রীর দুর্গ ভাঙতে ময়দানে আর এক মন্ত্রী। টলিউড দখলের যুদ্ধে এই রণকৌশলই নিচ্ছে বিজেপি।
একচেটিয়া সবুজটা আর নেই। টালিগঞ্জের সিনেমা-টেলিভিশন পাড়ায় বেশ কিছু দিন ধরেই গেরুয়া রং উঁকি দিতে শুরু করেছে ইতিউতি। শিল্পী বা কলাকুশলীদের মধ্যে যাঁরা বিজেপিতে শামিল হয়েছেন ইতিমধ্যেই, তাঁদের প্রত্যেকের মুখে একই কথা— রাজ্যের এক মন্ত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্যে ‘শ্বাসরোধ’ হয়ে আসছিল।
কিন্তু গেরুয়া পতাকা ধরে কি সমস্যা কমেছে? কারও অনাকাঙ্ক্ষিত দাপটে কি আদৌ রাশ টানা গিয়েছে? রাশ যে টানা যায়নি, তা বিজেপি-ও জানে। তাই এ বার বড় পদক্ষেপ। রাজ্যের মন্ত্রীকে ঘিরে গড়ে ওঠা ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে ময়দানে নামানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাধিক সংগঠনকে এক ছাতায় আনার কাজ শেষ। কয়েক দিনের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে নতুন সংগঠন ‘খোলা হাওয়া’।
তৃণমূল এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে অরূপ বিশ্বাসের প্রভাব ক্রমশ বেড়েছে। একা মন্ত্রী অরূপ নন, তাঁর ভাই স্বরূপও টলিউডে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। সাংগঠনিক ভাবে তাঁরা খুবই সক্রিয় ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে।
আরও পড়ুন: রাজীবের ছুটি নিয়ে বিভ্রান্তি! মেয়াদ শেষে কী করবেন ‘পলাতক’ গোয়েন্দা প্রধান, দেখতে চায় রাজ্যও
সম্প্রতি বিজেপি টলিউডে অল্প অল্প করে পা ফেলতে শুরু করে। লোকসভা ভোটের আগেই টলিউডের কিছু পরিচিত মুখ গেরুয়া ছাতার তলায় ভিড়তে শুরু করেছিলেন। ভোটের ফল প্রকাশের পরে সে ঢল আরও বাড়ে। তবে অরূপ-স্বরূপের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছতে যে এখনও অনেক দেরি, তা বিজেপি নেতৃত্বও বুঝতে পারছিলেন।
টলিউডে পা ফেলেও এগোতে না পারার কারণ কী? অন্যতম প্রধান কারণ হল শুরু থেকেই নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে থাকা। বিজেপির অন্দরেই অনেকে বলছেন যে, দলের নেতৃত্ব যদি নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ সমন্বয় রেখে টলিউড নিয়ে ভাবতেন, তা হলে এই পরিস্থিতি তৈরিই হত না। তাঁদের মতে, কোথাও কোনও সমন্বয়ই ছিল না, সাংগঠনিক ক্ষমতার এক একটি কেন্দ্রকে ধরে এক এক জন এক এক রকমের সংগঠন খুলতে শুরু করেছিলেন। ফলে টলিউডে নিজেদের যাত্রার শুরুতেই ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল গেরুয়া দল।
এক দিকে আত্মপ্রকাশ করেছিল ইআইএমপিসিসি নামে একটি সংগঠন, যার নেতৃত্বে ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল। অন্য দিকে বঙ্গীয় চলচ্চিত্র পরিষদ নামে আর একটি সংগঠনও বিজেপির ছাতার তলায় থেকেই কাজ শুরু করেছিল টালিগঞ্জের শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে। সেটির মাথায় ছিলেন বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরী, রন্তিদেব সেনগুপ্ত, শঙ্কুদেব পন্ডারা। এঁদের অনেক আগে থেকেই আবার বিজেপির হয়ে টালিগঞ্জে কাজ শুরু করেছিলেন অঞ্জনা বসু।
বিজেপি নেতৃত্ব এই পরিস্থিতির অবসান চাইছিলেন। তার জন্য সর্বাগ্রে তিন সংগঠনের নেতৃত্বকেই একত্রে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন সংগঠনের মাথায় এমন একজনকে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি, যিনি প্রভাবশালী তো বটেই, শিল্পী হিসেবেও গোটা দেশেই পরিচিত।
আরও পড়ুন: বালাকোটে ফের সক্রিয়তা, সীমান্তে অপেক্ষা করছে ৫০০ জঙ্গি, বললেন সেনাপ্রধান
বিজেপি সূত্রের খবর, গতকাল অর্থাৎ রবিবার রাতে বৈঠক বসেছিল বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তর কলকাতার বাড়িতে। টালিগঞ্জে বিজেপি ঘেঁষা যে তিনটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, সেই তিনটির নেতৃত্বই বৈঠকটিতে ছিলেন। আরও ছিলেন আরএসএসের বাংলা মুখপত্রের সম্পাদক রন্তিদেব সেনগুপ্ত এবং রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক তথা বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্ত। সেই বৈঠকেই নতুন সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ‘খোলা হাওয়া’।
টলিউডের এই নতুন গেরুয়া সংগঠনের সভাপতি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে। আহ্বায়ক শঙ্কুদেব পন্ডা, সহযোগী আহ্বায়ক অরিন্দম চক্রবর্তী। অগ্নিমিত্রা পাল এবং অঞ্জনা বসুকে সহ-সভানেত্রী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর সম্পাদক হচ্ছেন রূপা ভট্টাচার্য ও অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘খোলা হাওয়া’র প্রধান উপদেষ্টা হচ্ছেন স্বপন দাশগুপ্ত। রন্তিদেবও থাকছেন উপদেষ্টা হিসেবে।
বিজেপি যে টলিউডকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে, এই নতুন সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্তেই তা স্পষ্ট। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে এই সংগঠন আত্মপ্রকাশ করবে। সভাপতি এবং অন্যান্য পদাধিকারীদের নামও সে দিনই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত হবে। তবে সংগঠনকে পুরোপুরি রাজনৈতিক বলে মানতে রাজি নন সভাপতি পদে মনোনীত হওয়া বাবুল। আনন্দবাজারকে তিনি বললেন, ‘‘টলিউডে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে অত্যাচার সহ্য করছেন। পরিবেশ এতটাই ত্রাসের যে, অধিকাংশই মুখ খোলার সাহস পান না। সেই পরিস্থিতিটার অবসান ঘটানোই মূল লক্ষ্য, রাজনীতিটা নয়।’’ বাবুলের কথায়, ‘‘যাঁরা শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন, তাঁরাই এখানে দীর্ঘ দিন ধরে শিল্পকে বন্ধক রেখেছেন। আমাদের নতুন সংগঠনের কথা জেনে এমন এমন ব্যক্তিত্ব ফোন করেছেন যে, আমরা উদ্দীপ্ত।’’
আরও পড়ুন: এ বার আগাম জামিনের আবেদন হাইকোর্টে, রোজভ্যালি-কাণ্ডে সময় চাইলেন রাজীব
সংগঠনের আহ্বায়ক পদে যিনি বসতে চলেছেন, সেই শঙ্কুদেব পন্ডা অবশ্য একটু আক্রমণাত্মকই। অরূপ বিশ্বাস বা স্বরূপ বিশ্বাসের নাম না করেও তাঁদেরকে কটাক্ষে বিঁধছেন শঙ্কুদেব। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্বাস শব্দটা নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল টলিউডে। আসলে ওটা অন্ধবিশ্বাস। কারণ টলিউডে শিল্পী এবং কলাকুশলীদের স্বাধীনতা নেই। আমরা স্বধীনতা আনব। সবাই বুঝতে পারবেন, প্রকৃত বিশ্বাস আমাদের উপরেই রাখা যায়।’’ টলিউডে ‘কালোবাজারি’ চলছে বলেও এ দিন মন্তব্য করেন শঙ্কুদেব। আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘টেলিভিশনের প্রাইম স্লট বা সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে যাঁরা কালোবাজারি চালাচ্ছেন, তাঁরা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন যে ভারত এখন শাসন করছেন নরেন্দ্র মোদী। সুতরাং কালোবাজারির দিন শেষ। টলিউডে সিন্ডিকেট রাজ আমরা ভাঙবই।’’
রবিবার রাতের বৈঠকে যে ভাবে তিন সংগঠনকে একছাতার তলায় এনে ফেলেছে বিজেপি, তাতে স্পষ্ট যে, টলিপাড়ায় আরও সংগঠিত হচ্ছে গেরুয়া শিবির। বিজেপি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে সামনে রেখে নতুন সংগঠন তৈরি করার রণকৌশল সাজিয়েছেন খোদ দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়।