গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছ’দফা ভোট বাকি থাকতেই কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গিয়েছে ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় নিয়োগ হওয়া প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি। ভোটের মুখে সেই রায় নিয়ে ‘রাজনৈতিক ফসল’ ঘরে তুলতে কোমর বেঁধে নেমেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। পদ্মশিবির যে ভাষ্য রাখছে, তার পাল্টা আখ্যান রচনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বাম-কংগ্রেস। বিরোধী পরিসরে দু’পক্ষের আকচাআকচির মাঝে তৃণমূলের অবশ্য দাবি, বিরোধীরা দড়ি টানাটানি করলেও জনমত সরকারের পক্ষেই থাকবে। তার কারণ, যোগ্যদের চাকরিতে বহাল রাখার ব্যাপারে রাজ্য সরকার ভূমিকা পালন করেছে এবং করছেও।
বিজেপি সরাসরি বলছে, নিয়োগ বাতিলের এক এবং একমাত্র কারণ দুর্নীতি। যে দুর্নীতিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দিয়েছে তৃণমূল। আবার বাম-কংগ্রেসের বক্তব্য, বিজেপির এ নিয়ে কথা বলার কোনও নৈতিক অধিকারই নেই। কারণ, যে শুভেন্দু অধিকারী এখন তৃণমূল বিরোধিতার পুরোধা হতে চাইছেন, এই দুর্নীতির সময় সেই তিনি ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী এবং তৃণমূলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা।
বৃহস্পতিবার সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। এক, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকলকে গ্রেফতার করতে হবে। দুই, যোগ্যদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। তবে বিজেপির এ নিয়ে কথা না বলাই ভাল। কারণ, যে সময়ে তৃণমূল এই দুর্নীতি করেছিল, সেই সময়ে জোড়াফুলের জার্সি গায়ে এমন কিছু নেতা ছিলেন, যাঁরা এখন পদ্মফুলের জার্সি গায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। একদা তৃণমূলীরাই এখন বিজেপি সেজে ছদ্ম প্রতিবাদে নেমেছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সুমন রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি কেন খামোকা কথা বলছে বুঝতে পারছি না। চিটফান্ড থেকে নিয়োগ কিংবা রেশন— বাংলায় তৃণমূল জমানায় যা দুর্নীতি হয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তদন্তকে মাথা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি। কখনও গতি বাড়িয়েছে, কখনও থেমে গিয়েছে। বিজেপি সে সব নিয়ে কিছু বলে না। আর এই নিয়োগ দুর্নীতি যখন হয়েছিল, তখন শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী। এখন তিনিই বড় বড় কথা বলছেন।’’ সুমন আরও বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলছেন পুরুলিয়ায় কে চাকরি দিয়ে টাকা নিয়েছিল তিনি জানেন। অর্থাৎ, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান বিরোধী দলনেতা উভয়েই জানেন, কোথায় কী ভাবে দুর্নীতি হয়েছিল।’’
বাম-কংগ্রেস যখন বিজেপি এবং তৃণমূলকে এক করে দেখাতে চেষ্টা করছে, তখন তৃণমূল এবং বামেদের একই মুদ্রার দু’পিঠ বলে কটাক্ষ করেছে পদ্মশিবির। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সিপিএম এমন বিস্ময় প্রকাশ করছে, যেন ওদের আমলে নিয়োগে অস্বচ্ছতা, গণতন্ত্র হরণ হয়নি। এই প্রথম হচ্ছে!’’ শমীকের সুরেই রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ি বলেন, ‘‘দুর্নীতি, নিয়োগে অস্বচ্ছতায় সিপিএমের উত্তরাধিকার বহন করছে তৃণমূল।’’ বাম-কংগ্রেস যেমন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শুভেন্দুকে জড়িয়ে পদ্মশিবিরকে নিশানা করছে, তেমনই বিজেপি একদা বাম, এখন তৃণমূল নেতাদের উদ্ধৃত করছে। রাজর্ষি বলেন, ‘‘উদয়ন গুহ একসময় ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন বাম সরকারের মন্ত্রী। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর বাবাও অনেককে চাকরি দিয়েছেন। রাজারহাটের প্রাক্তন সিপিএম নেতা বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়ও বাম জমানার নিয়োগের অনিয়মের কথা বলেছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তৃণমূল কাদের উত্তরাধিকার বহন করছে।’’
যে দিন রায় ঘোষণা হয়েছিল, সে দিন তৃণমূলের অনেক নেতাই ঘরোয়া আলোচনায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ভোটে আদালতের রায়ের প্রভাব পড়বে। এক বর্ষীয়ান প্রার্থী ঘনিষ্ঠ মহলে এমনও বলেছিলেন যে, ‘‘ইচ্ছে করছে জেলে গিয়ে পার্থটাকে (চট্টোপাধ্যায়) কষিয়ে একটা চড় মেরে আসি।’’ তবে তিন দিন পর তৃণমূল যেন ততটাও কুঁকড়ে নেই। শাসকদলের নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধীরা যতই দড়ি টানাটানি করুক, কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ, সাধারণ মানুষ-সহ যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরাও দেখছেন, সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে। হাই কোর্টের রহস্যজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক রায়ে মুড়িমিছরি সব এক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার যোগ্যদের চাকরিতে বহাল রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে।’’