বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে মঙ্গলবার চলছে প্রস্তুতি ছবি— রণজিৎ নন্দী
রাজ্যে তৃতীয় দফায় সরকার গড়ার সময়েই তার অভিমুখ স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা হল, শিল্পায়ন এবং তার হাত ধরে কর্মসংস্থান। বিভিন্ন সামাজিক ও কল্যাণ প্রকল্পে সাফল্যের ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে এ বার যে বড় শিল্পের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ টানতে রাজ্য মরিয়া, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। এই আবহে করোনা-কাল পেরিয়ে দু’বছর পরে ফের আয়োজিত হতে চলেছে দু’দিনের বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলন (বিজিবিএস)। বুধবার তার সূচনা রাজারহাটে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসবেন কি না, সে সম্পর্কে রাত পর্যন্ত ধোঁয়াশাই রয়েছে।
প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, বিনিয়োগে বাংলা এখন আকর্ষণীয় গন্তব্য বলেই এই সম্মেলনের মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের অনেকে। যোগ দিচ্ছে অনেকগুলি দেশের প্রতিনিধিদল। কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, এর আগের পাঁচটি সম্মেলনে যে বিপুল অঙ্কের (সরকারের দাবি, প্রায় ১২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা) লগ্নি প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছিল, আদপে এসেছে তার কতখানি? বেহালা থেকে বাঁশদ্রোণী— প্রোমোটিং এবং সিন্ডিকেট ঘিরে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রসঙ্গ তুলে তাঁদের কটাক্ষ, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে এখানে টাকা ঢালতে আসবে কোন সংস্থা!
কোভিড, লকডাউন এবং তার পরেও ঢিমে বৃদ্ধির অর্থনীতিতে লগ্নি বাড়ন্ত প্রায় সারা দেশেই। এই অবস্থায় বড় বিনিয়োগ টানা এ রাজ্যেও মুখের কথা নয়। কিন্তু প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তাজপুরে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে রাজ্য। তাতে আগ্রহ দেখিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। জমি-জট কাটলে ডেউচা-পাঁচামিতে বড় কয়লা খনি প্রকল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে আশা জাগিয়েছে তেল। জঙ্গলমহলে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার লগ্নি সম্ভাবনাও উল্লেখযোগ্য। লগ্নি আসতে পারে তথ্যপ্রযুক্তিতেও।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সম্মেলনে আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির আসা কার্যত নিশ্চিত। এ ছাড়া হীরানন্দানি, জিন্দল, চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর কর্ণধারেরা থাকতে পারেন। আসতে পারেন উইপ্রো কর্ণধার আজিম প্রেমজি, রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর মুকেশ অম্বানীও। আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, কেনিয়া, চিন, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, জাপান-সহ ১৪টি দেশের প্রতিনিধিদল আসছে সম্মেলনে।
গৌতম আদানি এবং হলদিয়া পেট্রোকেমের কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় কী ঘোষণা করেন, সে দিকে নজর রয়েছে। সম্মেলনের আগে, মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা নৈশভোজে যোগ দিয়েছেন দেশি-বিদেশি শিল্পমহলের অনেকে। ছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও।
এক দশকে রাজ্যে উল্লেখযোগ্য বড় শিল্প তেমন আসেনি। কিন্তু রাজ্যের দাবি, ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পে উন্নতি চোখে পড়ার মতো। রাস্তা-সহ সার্বিক পরিকাঠামো ও শিল্পতালুক পরিকাঠামোয় জোর দেওয়া হয়েছে। নষ্ট হয়নি কর্মদিবস। সবুজ সাথীর সাইকেল এবং স্কুল পড়ুয়াদের পোশাক তৈরির মতো প্রকল্পে নতুন লগ্নি এবং কর্মসংস্থানের দিক খুলে গিয়েছে। কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এক কোটির বেশি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বাংলায় তোলা-শিল্প চলছে। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা খারাপ, সিন্ডিকেট নিয়ে মারামারি। কে আসবেন এ রাজ্যে!’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বাংলায় এখন তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট ছাড়া কোনও শিল্প নেই।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘আদানির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক ভাল। শিল্প সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে উভয়কে খুশি করার চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের পাল্টা জবাব, ‘‘রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করছেন বিরোধীরা। ...সরকারের অবস্থান মজবুত বলেই শিল্পপতিরা রাজ্য নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এখানে কর্মসংস্থানের ছবিও উজ্জ্বল।’’
সম্মেলন শুরু হওয়ার আগের দিনই বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে দু’দেশের সীমান্ত-বাণিজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াও পাট এবং চর্ম শিল্পে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে কথা হয়। বিশ্ব বাংলা মেলা প্রাঙ্গণে বণিকসভা ফিকির জাতীয় এগ্জ়িকিউটিভ কমিটির বৈঠকেও যোগ দেন মমতা।