Panchayat Vote

এক সূত্রে গাঁথা কেশপুরের রফিকুল, সিউড়ির ফাইজুলের পরিবার

গত এক মাসে বীরভূমে রাজনৈতিক খুন, বোমাবাজি এবং অস্ত্র উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটেছে বেশ কিছু। খুন হয়েছেন এক তৃণমূল কর্মী। পাশাপাশি, জেলা জুড়ে প্রচুর বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:০২
Share:

বোমা বিস্ফোরণে কয়েকটি জেলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে রেক্সোনা বিবির। বছর তিরিশের রেক্সোনা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের চড়কা গ্রামের বাসিন্দা। গত ১৬ নভেম্বর সকালে চড়কা এলাকায় তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। চলে বোমাবাজি। সেই বোমার আঘাতে ডান হাতের কিছুটা অংশ উড়ে গিয়েছে রেক্সোনার স্বামী শেখ রফিকুল আলি (৩৫)-র।

Advertisement

রফিকুল তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী। জখম হওয়ার পর তিনি ভর্তি ছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। অস্ত্রোপচারের পর ডান হাতের কিছুটা অংশ বাদ গিয়েছে তাঁর। খাটাখাটনি করেই সংসার টানতেন রফিকুল। সেই তাঁর ডান হাতটাই উড়ে গেল বোমায়! রেক্সোনার প্রশ্ন, ‘‘আমার তিন মেয়ে। স্বামী তো অকর্মা হয়ে গেল! সংসারটা কী করে চলবে?’’

একই প্রশ্ন গত ৫ নভেম্বর বীরভূমের সিউড়ির বাঁশজোড়ে খুন হওয়া তৃণমূল কর্মী ফাইজুল শেখের পরিবারেরও। ঘটনাচক্রে, ঠিক তখনই বীরভূম সফরে গিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী কড়া বার্তা দেওয়ার পরেও বীরভূমে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় বোমা পড়ে। গুরুতর আহত হন তৃণমূল কর্মী সাদ্দাম। ফাইজুলের পরিবারের দিন চলবে কী করে!

Advertisement

প্রশ্ন আছে। উত্তর নেই।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়েও এমন ‘ভুল’ কারণে খবরে ছিল বীরভূম। যে জেলার সঙ্গে উচ্চারিত হয় সেখানকার অনুব্রত মণ্ডলের নামও। ২০১৮ সালের মে মাসে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন, বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে বেরোলে দেখবেন, রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাস্তবে দেখা গিয়েছিল, বীরভূমের ৪২টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে ৪১টিতেই মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি বিরোধীরা। এক মাত্র আসনে যিনি মনোনয়ন জমা দেন, তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন পরে। অধুনাপ্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘যথার্থ এই বীরভূমি-/ উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে/ পেয়েছি শেষ তীরভূমি।/ দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’

যার জবাবে অনুব্রত তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘এ কোন কবি? আমরা তো কবি বলতে জানতাম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। এ কোন নতুন কবি উঠে এসেছেন, যে আমার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছেন।’’

কবি প্রয়াত। অনুব্রত কারাবন্দি। বীরভূম আবার এসে দাঁড়িয়েছে আরও একটি পঞ্চায়েত ভোটের সামনে। জেল থেকে আদালতে যাতায়াতের পথে সেই অনুব্রতই বার্তা দিয়েছেন ‘সুস্থ ভাবে’ হবে পঞ্চায়েত ভোট। বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি বলেছেন, ‘‘ফাঁকা থাকবে বিডিও অফিস। নিজে নিজেই ফাইল করবে আবার নিজে নিজেই চলে আসবে।’’ কখনও তিনি বলেছেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হলে দেখে নেবেন। আমরা চাই সুস্থ ভাবেই ভোট হোক। ভদ্র ভাবে, সুস্থ ভাবে ভোট হবে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে কোনও গন্ডগোল হয়েছিল কি? সেই রকম ভোট হবে।’’ আবার দলীয় কর্মীদের ‘গ্রুপবাজি’ বন্ধ করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।

তবে, গত এক মাসে বীরভূমে রাজনৈতিক খুন, বোমাবাজি এবং অস্ত্র উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটেছে বেশ কিছু। খুন হয়েছেন এক তৃণমূল কর্মী। পাশাপাশি, জেলা জুড়ে প্রচুর বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণত গ্রামেগঞ্জে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওয়ান-শটার বা বন্দুক জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। কিন্তু বীরভূমে একাধিক ক্ষেত্রে উদ্ধার হয়েছে নাইন এমএম এবং সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ এমএম-এর মতো আধুনিক পিস্তল। যা বিহারের মুঙ্গের থেকে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় হয়ে বীরভূম-সহ রাজ্যের অন্যত্র ঢুকছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু এলাকায় এখনও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। সেই পথেও অস্ত্র ঢোকার সম্ভাবনা রয়েছে। শীতে শুকিয়ে যাওয়া অরক্ষিত নদীখাত হয়ে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে অস্ত্র ঢোকে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, সমশেরগঞ্জ, ডোমকল-সহ কয়েকটি এলাকায়। বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র নেপাল থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে মুর্শিদাবাদের-মালদা সীমানাবর্তী থানা এলাকায় ঢুকে পড়ছে।

বীরভূমের পুলিশ সুপার নগেন্দ্র ত্রিপাঠী বলেছেন, ‘‘আমরা বোমা, অস্ত্রের উৎস চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ভিন্‌রাজ্যের সীমানাবর্তী এলাকায় নাকা তল্লাশি বাড়িয়েছি। জেলার সমস্ত থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এলাকায় বোমা, বন্দুক উদ্ধার করার জন্য। বেশ কয়েকটা থানা থেকে তাই রোজ অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে।’’

কিন্তু পুলিশ যতই আশ্বাস দিক, আতঙ্ক ছাড়ছে না সাধারণ মানুষকে। নিহত ফাইজুলের গ্রামের বাসিন্দা মাসুদের কথায়, ‘‘গ্রামে আমরা এখন বাস করতে পারছি। কারণ, পুলিশ-প্রশাসন আছে। ক্যাম্প আছে। পুলিশ ঘন ঘন গ্রামে টহল দিচ্ছে। কিন্তু দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ঝামেলা তো এখনও মেটেনি। ফলে ভয় থাকছেই।’’

উদ্বেগের ছবি গঙ্গার তীরবর্তী দুই জেলা নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদেও। সেখানেও গত এক মাসের মধ্যে অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে। তথ্য বলছে, গত এক মাসে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলায় উদ্ধার হয়েছে ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১০৬টি কার্তুজ। রানাঘাট পুলিশ জেলায় উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ১২টি। কার্তুজ ১৭টি। মুর্শিদাবাদ পুলিশ জেলায় উদ্ধার হয়েছে ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৩২টি কার্তুজ। জঙ্গিপুর পুলিশ জেলায় মিলেছে ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ রাউন্ড কার্তুজ। পাওয়া গিয়েছে প্রচুর হাতবোমা এবং সকেট বোমা।

এই আবহে পঞ্চায়েত ভোট হলে বিপদের আশঙ্কা করছে গেরুয়া শিবির। মুর্শিদাবাদ জেলা বিজেপির সভাপতি শাখারভ সরকারের কথায়, ‘‘ভোটে অশান্তি পাকাতেই তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী অস্ত্র মজুত করা শুরু করেছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকে তাদের সুবিধা করে দিচ্ছে।’’

নদিয়া জেলা সিপিএমের সম্পাদক সুমিত দে-র দাবি, ‘‘তৃণমূল এবং বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য পেশিশক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করা। বেআইনি অস্ত্র ব্যবহার করে পঞ্চায়েত ভোটকে বানচাল করতে চাইছে দুই দল। গণতান্ত্রিক উপায়ে তার প্রতিরোধ হবে।’’

ঘটনাচক্রে, নদিয়া জেলার তাহেরপুর পুরসভাই রাজ্যের এক মাত্র বাম ঘাঁটি। সদ্য স্বীকৃতি পাওয়া ওই পুরবোর্ড এখন বামেদের দখলে। যদিও গত বিধানসভা নির্বাচনের হিসেবে তাহেরপুরের জেলা নদিয়ায় এগিয়ে বিজেপি। কারণ, গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই নদিয়ায় কিছুটা মাটি হারিয়েছে তৃণমূল। মতুয়া ভোটের একটি বড় অংশ তৃণমূলের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বিজেপির ঘরে। নদিয়ার ১৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৮টি বিজেপির দখলে। তবে পুরভোটে রানাঘাট পুরসভা দখল করে নদিয়ায় আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে জোড়াফুল শিবির। কিন্তু একইসঙ্গে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলেও নদিয়া অগ্রগণ্য।

নভেম্বরে নদিয়া সফরে গিয়ে মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, পঞ্চয়েত ভোট তাঁর ‘পাখির চোখ’। নদিয়া জেলায় দলের সব শিবিরকে এক ছাতার তলায় এসে লড়াইয়ে নামতে হবে। ভোটের জন্য একটি সমণ্বয় কমিটিও গড়ে দিয়েছিলেন মমতা। ভোটের মুখে ভিন্‌ রাজ্য থেকে অস্ত্র আমদানি নিয়ে পুলিশকে সতর্ক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিপুল ভাবে জয়ী হয়ে সংসদে প্রথম বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘বিরোধী শক্তি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, সেই শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করা উচিত নয়।’’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ক্ষুদ্রকে রক্ষা করা বৃহতের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যদিও মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী শক্তির কণ্ঠরোধ করা এবং দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেই মোদীর দল বিজেপি বাংলায় মূল বিরোধী শক্তি। তারাই সরবে প্রশ্ন তুলছে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের অধিকার নিয়ে। বলছে, আগামী পঞ্চায়েত ভোট কি ‘অবাধ’ হবে? (চলবে)

লেখা: কণাদ মুখোপাধ্যায়। তথ্য সংকলন: সৈকত ঘোষ, অমিতা দত্ত, সুমন মণ্ডল, মৌসুমী খাঁড়া, প্রণয় ঘোষ এবং তরুণিমা মণ্ডল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement