জলাশয় ভরাটের অভিযোগ পেয়ে পরিদর্শনে যান বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান পরেশচন্দ্র সরকার। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
বর্ধমান শহরের প্রায় ৩০০ বিঘা জলাভূমি ‘শশাঙ্ক বিল’ ভরাট করার চেষ্টার অভিযোগকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়ে। আনন্দবাজার অনলাইনেই এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরই নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। বুধবার বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান পরেশচন্দ্র সরকারের নির্দেশে আপাতত বন্ধ হয়ে গেল জলাশয় ভরাটের কাজ। জেলাশাসকের সিদ্ধান্ত মেনেই পরবর্তী পদক্ষেপ, জানিয়ে দিলেন পুরসভার চেয়ারম্যান।
‘শশাঙ্ক বিল’ ভরাটকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরেই উত্তেজনা ছড়িয়েছিল বর্ধমান শহরে। স্থানীয়দের দাবি, সকলের অজান্তেই মাটি খোঁড়ার মেশিন এনে জলাভূমি ভরাটের কাজ চলছে। অভিযোগ, এক অসাধু চক্র এই কাজ করছে। বিষয়টি যাতে প্রকাশ্যে না আসে, সেই কারণে বিলের জায়গায় বড় টিনের গেট করে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের ওই অংশে প্রবেশে ‘বাধা’ দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ।
সেই খবর পেয়ে বুধবার দুপুরে বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান সদলবলে শশাঙ্ক বিল পরিদর্শনে যান। তিনি যখন সেখানে পৌঁছন, তখন পুরোদমে জলাভূমি ভরাটের কাজ চলছিল। তিনি গিয়েই জলাশয় ভরাটের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। পরেশ বলেন, ‘‘এটা বিশাল জলাশয়। এখানে ভরাটের কাজ যাঁরা করছেন আর ভূমি সংস্কার দফতর— দু’জায়গায় ভিন্ন কাগজ আছে। ভরাটের কাজ করছে যে সংস্থা, তাদের কাছে যা কাগজ আছে তাতে লেখা হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা। কিন্তু ভূমি সংস্কার দফতরের কাগজে লেখা অন্য কথা। তাই আমরা গোটা বিষয়টি জেলাশাসকের কাছে পাঠাব। জেলাশাসক সব পক্ষের কাগজপত্র দেখে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা মানা হবে।’’
পুরসভার চেয়ারম্যান আসার আগে ওই এলাকায় এসেছিলেন বর্ধমান ১ নম্বর ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক বিশ্বজিৎ ঘোষ। কিন্তু বিল ভরাটের জায়গায় প্রবেশ করতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়। যদিও পরে সেখানে ঢুকে পরিদর্শন করেন। বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘আমি অতিরিক্ত জেলা শাসকের (ভূমি) নির্দেশে পরিদর্শনে এসেছি। আমি রিপোর্ট জমা দেব অতিরিক্ত জেলা শাসকের কাছে।’’
যদিও জলাশয় ভরাটের দায়িত্বে থাকা সংস্থার ইঞ্জিয়ার চিন্ময় সাহা বলেন, ‘‘আমরা বেআইনি ভাবে কোনও কাজ করিনি। তবে পুরসভার চেয়ারম্যান এখন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই কাজ বন্ধ রাখা হচ্ছে।’’ এ বিষয়ে জেলাশাসক আয়েশা রানী বলেন, ‘‘অভিযোগ পেয়েছি। আমি ভূমি দফতরকে বলেছি তদন্ত করতে।’’
কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ‘বিতর্কিত’ শশাঙ্ক বিলের জমির চরিত্র বদল হয়। ২০১৫ সালে জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক জমির চরিত্র হাউসিং কমপ্লেক্সে পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে জমির চরিত্র বদলের যে দাবি পুরসভা করছে, তাতে বিস্তর গলদ ধরা পড়ে। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ পুরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান একটি নির্দেশিকা জারি করেন। তাতে উল্লেখ ছিল, হাই কোর্টের আইনজীবীর অতিরিক্ত হলফনামা অনুযায়ী পুরসভার যে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাতে জালিয়াতি করা হয়েছে। শংসাপত্রে চেয়ারম্যানের সই জাল করার এবং ভুয়ো মেমো নম্বর বসানোর অভিযোগ ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গড়েন। তদন্তের পর চেয়ারম্যান ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেটের বিষয়ে তাঁর আপত্তির কথা জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিককে জানিয়েছিলেন। বর্ধমান থানায় এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ দায়ের করেন। তার পর হঠাৎ করে জলাভূমি বোজানোর কাজ শুরু হওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
পুরসভার রেকর্ড অনুযায়ী, জমিটি ২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ৩৩৩ নম্বর দলিল মূল্যে বিক্রি হয়। সেই সময় জমির চরিত্র যে বিল এবং জলাভূমি ছিল তা পুরসভার নথিতেই পরিষ্কার। জমির চরিত্র বদলের আবেদন জমা পড়ার পর পুরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলার এবং আধিকারিকেরা জমি পরিদর্শনে যান। সে সময় পুরসভার তরফে বিভিন্ন দফতরে জমির চরিত্র বদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়। তার পরেও কী ভাবে জলাজমি শালিতে পরিণত হল তা নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। প্রভাবশালীদের তত্ত্বাবধানেই জলাজমির চরিত্র বদল হয়েছে বলে মনে করছেন শহরবাসী। গত রবিবার বর্ধমান শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ও তার আশপাশে ব্যাপক প্রচার করে বিজ্ঞানমঞ্চ।