—ফাইল চিত্র।
কাজি নজরুল ইসলামের সৃষ্টি ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানে এআর রহমানের নয়া-সুর নিয়ে সমালোচনার ঝড় তীব্র হচ্ছে বিভিন্ন মহলেই। এ বার তামিল সঙ্গীত পরিচালক রহমানের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল নজরুলের জন্মভিটে চুরুলিয়া। গানটি অবিলম্বে না সরানো হলে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে কবির পরিবার।
’৭১-এর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘পিপ্পা’ ছবিতে রহমানের সুর করা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। চুরুলিয়াবাসীর বক্তব্য, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এই গানটি। সেই গানের সুরে রহমান যে ‘আঁচড়’ দিয়েছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। আজও কবিতীর্থ চুরুলিয়ার নজরুলের প্রচুর গানের পাণ্ডুলিপি, তানপুরা, গ্রামোফোন রাখা রয়েছে। রয়েছে নজরুল অ্যাকাডেমি ও নজরুল গবেষণাগার। নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র তথা চুরুলিয়া নজরুল অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কাজি রেজাউল করিম বলেন, ‘‘প্রায় ১০০ বছর লেখা যে গান শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দেয় আপামর দেশবাসীর, যে গান শুনলে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলি চোখের সামনে তরতাজা হয়ে ওঠে, সেই গানের সুরটাই বদলে দিয়েছেন এ আর রহমান। এই ঘটনা দুঃখজনক। আগুন নিয়ে খেলা করছেন রহমান সাহেব।’’
কবির পরিবারের দাবি, রহমান সুর বিকৃত করে ‘বেআইনি’ কাজ করেছেন। গানটি না সরানো হলে আদালতে মামলা করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন নজরুলের পরিবারের সদস্যেরা। নজরুল অ্যাকাডেমির সদস্য ও কবির নাতনি সোনালি কাজি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘এই কাজটি করার আগে কারও সঙ্গে কথা বলেছিলেন উনি (রহমান)? অতীতে যখন মহম্মদ রফি ও অনুপ জালোটা কাজি নজরুল ইসলামের গান গেয়েছিলেন, তখনও মূল সুর পরিবর্তন হয়নি। তাই কোনও বিতর্ক হয়নি। আপামর বাঙালি সেই গানকে মেনে নিয়েছেন এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। কিন্তু রহমান সাহেব যেটা করেছেন, তা অনৈতিক ও বেআইনি। বহু দিন আগের একটা গান কোন অধিকারে উনি বদলে দিতে পারেন, এটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।”
সমালোচনার পারদ চড়লেও রহমান নিজে বা ছবির নির্মাতারা এখনও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে নজরুলের সৃষ্টি নিয়ে বলিউডের কাটাছেঁড়া যে সহজে হজম করছেন না বাঙালি দর্শক-শ্রোতা-শিল্পীরা, তা স্পষ্ট। বাংলার সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায় বলেন, ‘‘এই গান কার নির্দেশে তৈরি হল, সেটা আগে জানা প্রয়োজন। এ আর রহমানকে ছবির পরিচালক কী বলেছেন, আমরা কেউই কিন্তু জানি না। রহমান এমনটা কেন করলেন, তাঁর বক্তব্যটা জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন ছবিতে কাজ করি, আমাদের পরিচালক-প্রযোজকের তরফে যা বলা হয়, তাই-ই করতে হয়। প্রেক্ষাপট না জেনে প্রথমেই সমালোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়াটা সময় নষ্ট বই কিছু নয়।’’ সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের গলাতেও প্রায় একই সুর।
প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ও পার বাংলাতেও। বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষের এক জন বিখ্যাত সুরকার খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কাজী নজরুলের অসম্মান হয়েছে এতে। গানটি যাতে প্রচার না পায়, তার ব্যবস্থা করা দরকার।’’ সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনেরও প্রশ্ন, ‘‘কাজী নজরুল ইসলামের এই ‘ভাঙার গান’-এর সুর বিকৃত করার দায় সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের, না কি সংশ্লিষ্ট ছবিটিতে যাঁরা তাঁকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন, সেই পরিচালক-প্রযোজকের?’’ বস্তুত, তসলিমার মতে, ‘তামিল ছেলে’ এ আর রহমান হয়তো জানেনই না, কাজী নজরুল ইসলাম কে ছিলেন। তিনি লিখছেন, ‘‘গানটির অর্থ হয়তো তাঁকে ব্রিফ করা হয়েছে, সেই অর্থ অনুযায়ী এ আর রহমানের যে সুর পছন্দ হয়েছে সেই সুরই তিনি ফাইনাল করেছেন। আমার মনে হয় না, গানটির আসল সুর শুনে সেটি কিচ্ছু হয়নি বলে তিনি নতুন সুর দিয়েছেন। যদি দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা বন্ধ করার দায়িত্ব পরিচালক এবং প্রযোজকের ছিল। দোষ কারও একার নয়, টিমের দোষ।’’