বসেছে এই মূর্তি। নিজস্ব চিত্র
তাঁর পাণ্ডিত্য নাড়া দিয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। সংস্কৃত কলেজের প্রথম শ্রেণির অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে রাজি করাতে ১৮৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে হেঁটে কালনায় এসে পৌঁছেছিলেন বিদ্যাসাগর। তবে বাসভূমি কালনা শহরেই এত দিন অবহেলিত ছিলেন ভারত বিখ্যাত পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি। সোমবার শ্যামরাইপাড়ায় তাঁর ভিটেতে আবক্ষ মূর্তি বসল তারানাথের। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সরকারিউদ্যোগে সাজিয়ে তোলা হোক তারানাথের বাড়ি।
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজ তিলকচাঁদ মহারাজাধিরাজ খেতাব পাওয়ার পরে দীঘি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বহু পণ্ডিতদের আহ্বান জানিয়েছিলেন কালনার সমাজবাড়িতে। সেই সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন তারানাথের পিতামহ পণ্ডিত রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তিলকচাঁদ কালনার ভাগীরথীর তীরে বার্ষিক বৃত্তি এবং জমিজায়গা দিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ওই পণ্ডিতকে। সেখানেই ১৮১২ সালের নভেম্বরে জন্ম হয় তারানাথের। বছর পাঁচেক বয়সেই বাবা কালীদাস সার্বভৌম ও জেঠামশাইয়ের ছেলে তারিণীপ্রসাদ ন্যায়রত্নের কাছে অরমকোষ, ভট্টিকাব্য, শিশুপালবধ অধ্যায়ন করতে শুরু করেন তিনি। সংস্কৃত কলেজে অধ্যায়ন করে তর্কবাচস্পতি উপাধি পান। কাশীতে গিয়ে বেদান্ত পাঠ করেন। ন্যায়শাস্ত্রের উচ্চতর পাঠ, শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডকাব্য’, পাণিনির ব্যাকরণ, বেদ-বেদান্ত, মীমাংসা-পাতঞ্জল প্রভৃতি দর্শন, গণিতশাস্ত্রেও অধিকার জন্মায় ওই সময়েই। ১৮৪৫ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরনের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। ‘শব্দস্তোম মহানিধি’ নামে পাঁচ খণ্ডের অভিধান ও বাচস্পত্যাভিধান সঙ্কলন করেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁর। বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে সই সংগ্রহের সময়ে দ্বিতীয় সইটি করেছিলেন তারানাথ। ১৮৮৫ সালে কাশীতে তাঁর মৃত্যু হয়।
ভারত বিখ্যাত এই পণ্ডিতকে নিয়ে দেশ বিদেশে চর্চা হলেও নিজভূমিতে তাঁকে ঘিরে তেমন উদ্যোগ করা হয়নি। কয়েক বছর আগে কালনার শিক্ষানুরাগী কিছু মানুষের উদ্যোগে তারানাথের একটি মূর্তি বসানো হয় তেঁতুলতলা এলাকায়। বছরে একটি করে অনুষ্ঠান হয় সেখানে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, একসময়ে শ্যামরায় পাড়ায় বড় এলাকা জুড়ে বাড়ি ছিল তারানাথের। এখন তা নেই। সম্প্রতি ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মৌসুমি কার্ফা পণ্ডিতের ভিটেটি সংস্কারে উদ্যোগী হন। ঠিক হয়, তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তির বসানো হবে। কাউন্সিলারের স্বামী তথা প্রাক্তন শিক্ষক তাপসকুমার কার্ফা মূর্তি তৈরির খরচ দেন। সোমনাথ পণ্ডিত, আশিস প্রামাণিকের মতো কয়েকজনও এগিয়ে আসেন। তৈরি হয় পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি স্মৃতিরক্ষা কমিটি। এ দিন রাজ্যের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, কালনার বিধায়ক দেবপ্রসাদ বাগ, পুরপ্রধান আনন্দ দত্তের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হয় আবক্ষ মূর্তিটি।
তারানাথ পণ্ডিতকে নিয়ে বই লিখেছেন শহরের বাসিন্দা সিদ্ধেশ্বর আচার্য। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এই ভিটেতে প্রথমে সংস্কৃত কলেজের পরিচালন সমিতির সম্পাদক রামকমল সেন, পরে বিদ্যাসাগর এসেছিলেন। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভিটেতে তারানাথের স্মৃতিতে কিছু একটা হচ্ছে, এটা দেখে ভাল লাগছে।’’ মন্ত্রী বলেন, ‘‘তারানাথ তাঁতশিল্প এবং গোপালনের ব্যবসাতেও সফল হয়েছিলেন। ভারত বিখ্যাত এই পণ্ডিতকে নিয়ে গবেষনা হওয়া উচিত।’’ আগামী প্রজন্ম যাতে তারানাথকে জানতে পারেন, তার জন্য উদ্যোগ করা হবে জানান বিধায়ক ও পুরপ্রধান।