জেলা সমাজকল্যাণ দফতরে ঢোকার পথে। নিজস্ব চিত্র
পাহাড়-সাগর ডিঙিয়েছেন ওঁরা। জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতাও জয় করছেন প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু দৈনন্দিন লড়াইয়ে যুঝতে অনেক সময়েই ন্যূনতম সাহায্যটুকুও পান না তাঁরা।
ওঁদের সাফল্যে মঞ্চে ডেকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রশাসনের কর্তারাও পিঠ চাপড়ে দেন। এগিয়ে চলার জন্যে উৎসাহ দেন। কিন্তু তাঁদের কাছে পৌঁছতে গিয়েই কতখানি হোঁচট খেতে হয় তার খোঁজ রাখেন না তাঁরা।
আজ, ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ওই মানুষজনের আর্জি, হাসপাতাল, সরকারি দফতরে সহজে ওঠা-নামার ব্যবস্থাটুকু অন্তত করা হোক।
জেলাশাসকের দফতরের কাছে হকার্স মার্কেটের ঠিক পিছনেই একটি চারতলা ভবনে জেলা সমাজকল্যাণ দফতর (পূর্ব বর্ধমান)। প্রতিবন্ধী কার্ড, প্রতিবন্ধী ভাতা, মানবিক ভাতার মতো বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সেখানে হামেশাই যেতে হয় তাঁদের। প্রতিবন্ধীদের অভিযোগ, “অস্থি-প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ২৩টি সিঁড়ি ভেঙে দফতরে যাওয়া খুবই কষ্টের। বারবার থামতে হয়।’’ বিভিন্ন wস্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফেও ওই দফতরে র্যাম্প তৈরির দাবি জানানো হয়েছে। এমনই একটি সংগঠনের সভাপতি অধীর বিশ্বাস ও সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “হুইলচেয়ার রাস্তায় রেখে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। সমাজকল্যাণ দফতর দ্রুত একতলায় করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’’
সোমবারই গলসি থেকে এসেছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। ওই দফতরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় বলেন, “আমাদের জন্য নাকি বিশেষ দিন আছে। কিন্তু রোজ কী দশা হচ্ছে, সে খবর কেউ রাখে?’’
সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিক (পূর্ব বর্ধমান) প্রশান্ত রায় বলেন, “প্রতিবন্ধীদের দাবি ন্যায্য। আমরা জেলা পরিষদের একটি ভবনে রয়েছি। এখানে র্যাম্প করার মতো জায়গা নেই।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘জেলাশাসকের দফতরের পাশে নতুন ভবন হচ্ছে। সেখানে একতলায় দফতরটি পেলে প্রতিবন্ধী মানুষদের সুবিধা হবে।’’
প্রতিবন্ধীদের অভিযোগ, শুধু সরকারি দফতর নয়, বাসে উঠলেও বসার জায়গা মেলে না। প্রতিবন্ধী কার্ড থাকলেও ভাড়ায় ছাড় পাওয়া যায় না। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বাসের প্রথম দিকে দু’টো আসন ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত’ বলে লেখা বাধ্যতামূলক। গলসি, রায়না, আউশগ্রাম-সহ বিভিন্ন রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষজনের অভিজ্ঞতা, “বেসরকারি বাসে উঠলে বসার জায়াগা মেলে না। কিছু বলতে গেলে কন্ডাক্টর বাস থেকে নামিয়ে দেন। প্রতিবন্ধী শংসাপত্র থাকলেও জোর করে ভাড়া নেওয়া হয়।’’ কয়েক মাস আগে, গলসির কুলগড়িয়ায় এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিন প্রতিবন্ধী। ঘণ্টাখানেক বাস আটকে দিয়েছিলেন তাঁরা। পরে কন্ডাক্টর-খালাসি ‘আর ভুল হবে না’ বলার পরে বাস ছাড়া পায়। ওই এলাকার এক বাসিন্দা কালীরাম রায় বলেন, “প্রতিটি প্রতিবন্ধী ভাইকে বলেছি, কোনও রকম অবহেলার শিকার হলেই থানায় অভিযোগ জানাতে হবে।’’
আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক (পূর্ব বর্ধমান) রানা বিশ্বাসও বলেন, “প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসের সামনের দু’টি আসন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।’’
জেলায় হাজারের কাছাকাছি বাস চলে। তার একটিতেও যে সংরক্ষণ নেই, মেনে নিচ্ছেন বর্ধমান বাস মালিকদের সংগঠনের কর্তা তুষার ঘোষ। তাঁর দাবি, “নিত্যযাত্রীদের একাংশই সংরক্ষণ লেখা তুলে দেন। কোনও নিয়ম মানতে চান না। বাসকর্মীরাই বা কতক্ষণ অশান্তি করবেন। সে জন্যই সমস্যা হয়।’’ তবে বাসকর্মীরা যাতে মানবিক আচরণ করেন, সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়, তাঁর আশ্বাস।
প্রতিবন্ধীদের কথায়, ‘‘লড়ব তো আমরাই। শুধু অস্ত্রটুকু চাই।’’