তৃণমূলের কর্মিসভায় অরূপ বিশ্বাস। শনিবার আসানসোলে। — নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের জয়ের-জোয়ার মুখ থুবড়ে পড়েছিল আসানসোলে।
কর্পোরেশন ভোট থেকে সাকুল্যে পক্ষকাল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শিল্প-শহরে, শনিবার এক দলীয় কর্মিসভায় এসেছিলেন রাজ্যের যুবকল্যাণ মন্ত্রী তথা দলের বর্ধমান জেলা পর্যবেক্ষক অরূপ বিশ্বাস। এক বছর আগে, দলের ভরাডুবির কথা মনে করিয়ে নেতা-কর্মীদের এ দিন অরূপ যা বার্তা দিয়েছেন, তা থেকে স্পষ্ট— দলীয় কোন্দলে জেরবার শাসক দল আসানসোল কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে সিঁদুরে মেঘ দেখছে।
এসবি গড়াই রোডে এ দিনের সভায় হাজির ছিলেন আসানসোলের দুই বিধায়ক-সহ কুলটির চার বারের পুরপ্রধান উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় কিংবা রানিগঞ্জের বিধায়ক সোহরাব আলি। যাঁদের কেউ প্রার্থী হতে রাজি হননি। কেউ বা মনোনয়ন পেশ করেও বিতর্কের জেরে সরে দাঁড়িয়েছেন সদ্য। সেই সভায় অরূপ বলেন, ‘‘দিদির দেখানো রাস্তাই আমাদের হাতিয়ার। সে পথে না হেঁটে এক বার ভুল হয়ে গিয়েছে। ভুল যেন বারবার না হয়।’’
আসানসোলে দলীয় কোন্দল নতুন নয়। গত লোকসভা ভোটের প্রচারে এসে পোলো গ্রাউন্ডের জনসভায় মঞ্চ থেকে এ ব্যাপারে বার্তা দিতে হয়েছিল খোদ দলনেত্রীকে। স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের নাম ধরে সবাইকে ‘এক সঙ্গে কাজ করার’ নির্দেশ দিয়ে মমতা জানিয়ে গিয়েছিলেন, ‘‘কোনও মান অভিমান নয়, লড়াইটা এক সঙ্গে করতে হবে কিন্তু।’’ সে ‘লড়াই’ অবশ্য বিরোধীদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ছড়িয়ে পড়েছিল দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। লোকসভায় শাসক দলের প্রার্থী দোলা সেন বিজেপি-র বাবুল সুপ্রিয়ের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পরে, পিছন থেকে ছুরি মারারও অভিযোগ উঠেছিল আসানসোলের (উত্তর) বিধায়ক তথা মন্ত্রী মলয় ঘটকের বিরুদ্ধে। ‘শাস্তি’ হিসেবে কৃষিমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মলয়বাবুকে। মাস দুয়েক পরে শ্রম দফতরের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দিলেও আসানসোলে দলীয় বিভাজন যে জোড়া লাগেনি তা কবুল করছেন দলের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা। বলছেন, ‘‘কখনও প্রার্থী বাছাই, কখনও বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জুলুমবাজির অভিযোগ নিয়ে দলের নেতা-বিধায়ক-মন্ত্রীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে ক্রমাগত ছুটছেন কলকাতায়। যা দেখে দলের নিচুতলার কর্মী বুঝেই উঠতে পারছেন না, কোন পক্ষ নেবেন।’’
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রানিগঞ্জ, কুলটি কিংবা জামুড়িয়ায় গত কয়েক মাসে গোষ্ঠী-সংঘর্ষের বিরাম নেই। আসানসোলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে অন্তত তিনটি পক্ষ। স্থানীয় টিভি চ্যানেল থেকে সংবাদপত্রে এলাকার নেতাদের তর্জাও অব্যাহত।
অরূপের কথায় এ দিন সে ব্যাপারেই সতর্ক বার্তা শোনা গিয়েছে বলে দাবি সভায় উপস্থিত এক নেতার। লোকসভায় তৃণমূলের হারের কথা উল্লেখ করে অরূপ এ দিন কর্মীদের স্পষ্ট করে দেন, ‘‘এখনও যাঁদের অভিমান রয়েছে, তাঁদের বাড়ি থেকে বের করতে হবে। বিবাদ ভুলে দলের প্রার্থীদের আগে জিতিয়ে আনতে হবে। তার পরে দেখা হবে কার কী কারণে অভিমান।’’ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, কর্পোরেশন নির্বাচনের সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে বিধানসভায় আসানসোলের ‘ভবিষ্যৎ’। এ দিন অরূপ সতর্ক করে জানান, এক জন ‘মিরজাফর’কেও রেয়াত করা হবে না। দলের অন্দরের খবর, এ দিনের সভায় উপস্থিত দলের এক বিধায়ককে সরাসরি সতর্ক করে অরূপের ‘হুঁশিয়ারি’— ভুল এক বার হয়েছে। এ বার হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে কলকাতায় গিয়ে তিনি যেন মাথা উঁচু করে থাকতে পারেন। দলীয় প্রার্থীদের তিনি বলেন, ‘‘শুধু উত্তরীয় পরে ঘুরলেই হবে না। প্রত্যেক প্রার্থীকে ওয়ার্ডের প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে অন্তত ৩ বার দেখা করতে হবে। এই কথাগুলি বলার জন্যই দলনেত্রী আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।’’
আসন্ন কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজেপি-র মোকাবিলা করার দাওয়াইও এ দিন দিয়ে গিয়েছেন অরূপ। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় কী বলল না-বলল তা নিয়ে বিরোধিতা না করে গত চার বছরে রাজ্য জুড়ে কী হয়েছে এবং আসানসোলের জন্য রাজ্য সরকার
কী করেছে, সেটাই তুলে ধরুন। তা হলেই যথেষ্ট।’’