সাগরদিঘির ফলে চিন্তা তৃণমূলে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সাগরদিঘিতে হারার ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি। তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে পরাজয়ের কারণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর তাতেই উঠে আসছে যে, বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থীর পক্ষে বিজেপির ভোট চলে যাওয়া যদি একটা কারণ হয়ে থাকে, তবে আরও একটা কারণ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে চলতি তদন্ত। আরও স্পষ্ট করে বললে তৃণমূল শিবির মনে করছে, দলের প্রাক্তন মহাসচিব তথা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বে থাকা অবস্থায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি, তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে পাহাড়প্রমাণ নগদ অর্থ উদ্ধারের ঘটনার বড় প্রভাব পড়েছে সাগরদিঘির ভোটে। প্রসঙ্গত, পার্থ তথা নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে পশ্চিমবঙ্গে এটাই ছিল প্রথম কোনও নির্বাচন। আর সেখানে এই ভরাডুবিকে ‘অশনি সঙ্কেত’ বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
ফলঘোষণার পর থেকে তৃণমূল বলে চলেছে, সাগরদিঘিতে ‘অনৈতিক’ জোটের জন্যই দলের পরাজয়। তবে দলের অন্দরে অনেকেই মনে করছেন, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। বরং নিয়োগ তদন্তের অগ্রগতিতে একের পর এক নেতা, বিধায়ক গ্রেফতার হওয়ায় দলের ভাবমূর্তিতে যে ‘প্রভাব’ পড়েছে, সেটাও এই বিপর্যয়ের বড় কারণ। দলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ তা মানছেনও। পায়ে অস্ত্রোপচারের পর অসুস্থ কুণাল আপাতত হাসপাতালে। সেখান থেকেই শুক্রবার টেলিফোনে তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার এবং তার পরের ঘটনাবলি দলের যে ক্ষতি করেছে, তা অতীতে কখনও হয়নি। সাগরদিঘির ভোটের ফল খারাপ হওয়ার পিছনে সেটাই একমাত্র কারণ না হলেও অবশ্যই একটা কারণ।’’
তৃণমূল নেতারা তো বটেই, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বৃহস্পতিবার ফলঘোষণার পরে দাবি করেছেন সাগরদিঘিতে ‘অনৈতিক’ জোট হওয়াতেই দলের হার। তিনি বলেছেন, ‘‘সাগরদিঘি উপনির্বাচনে আমরা হেরেছি। কাউকে দোষ দেব না। গণতন্ত্রে হার-জিত লেগেই থাকে। কিন্তু এখানে অনৈতিক একটি জোট হয়েছে। যার তীব্র নিন্দা করছি আমরা।’’ বাংলায় বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএমের মধ্যে ‘লেনদেনের সম্পর্ক’ রয়েছে বলেও দাবি করেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির ভোট গুনলে দেখা যাবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২২ শতাংশ। এ বার ওরা নিজেদের ১৩ শতাংশ ভোট কংগ্রেসকে হস্তান্তরিত করেছে।’’
মমতা যে ভাবে ভোট ‘হস্তান্তর’ করার কথা বলছেন, তা অবশ্য মানতে রাজি নয় কংগ্রেস। তবে বিরোধীদের ভোট যে তাঁরা পেয়েছেন, তা মেনে নিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। বৃহস্পতিবার অধীর বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস প্রার্থী যেমন বামফ্রন্টের ভোট পেয়েছেন, তেমনই বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের বড় অংশের ভোটও পেয়েছেন। আর বিজেপির ভোটাররা যাঁরা এই ভোটে তৃণমূলের পরাজয় চেয়েছিলেন, তাঁরাও কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন।’’ অধীরের এমন বক্তব্যকে হাতিয়ার করেই আক্রমণ শানিয়েছিলেন মমতা।
তবে অধীরের দাবি বা মমতার বক্তব্য সম্পূর্ণ ভাবে মানতে চাইছেন না ভোট বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, নিজেদের বিপুল পরিমাণ ভোট অন্য বাক্সে সংগঠিত ভাবে ফেলে দেওয়ার জন্য ভোটারদের উপরে যে ‘নিয়ন্ত্রণ’ দরকার, এ রাজ্যে সেটা বিজেপির নেই। অন্তত মুর্শিদাবাদ জেলাতে তো নয়ই। তা ছাড়া সাগরদিঘিতে তৃণমূল হারলেও ততটা খুশি দেখায়নি বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে। বরং নিজেদের প্রাপ্ত ভোট কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তার ছাপই দেখা গিয়েছে ঘরোয়া আলোচনায়।
সাগরদিঘির ফলাফলের অঙ্ক কষতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, শুধু বিজেপির ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে এসে যাওয়াতেই তৃণমূলের হার নয়। পৌনে দু’বছর আগে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাগরদিঘিতে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৫,১৮৯টি ভোট। এ বার তারা পেয়েছে ৬৪,৬৩১। অর্থাৎ তৃণমূলের ভোট কমেছে ৩০,৫৫৮টি।
এ বার দেখা যাক বিজেপির হিসাব। এ বার গেরুয়া শিবির পেয়েছে ২৫,৭৯৩টি ভোট। ২০২১ সালে তারা পেয়েছিল ৪৪,৯৮৩টি ভোট। তার মানে বিজেপির ভোট কমেছে ১৯,১৯০টি।
এ বারে জয়ী কংগ্রেস ২০২১ সালে বামেদের সঙ্গে জোট গড়ে পেয়েছিল ৩৬,৩৪৪ ভোট। আর উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৮৭,৬১১ ভোট। অর্থাৎ, ভোট বেড়েছে ৫১,২৬৭টি।
কংগ্রেসের ভোট এতখানি বেড়ে যাওয়াতেই ২০২১ সালে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান (৫০,২০৬) টপকে ২২,৪২৮ ভোটে জিতেছেন কংগ্রেসের বাইরন বিশ্বাস। অঙ্ক বলছে, শুধু বিজেপির ভোট কাটা নয়, তৃণমূলের থেকে বেশি ভোট টেনে নিয়েছে কংগ্রেস। হিসাবমতো তৃণমূল এবং বিজেপির মোট ৪৯,৭৪৮টি ভোট (৩০,৫৫৮ + ১৯,১৯০) কাটার পরেও বাড়তি ১,৫১৯ ভোট (৫১,২৬৭ - ৪৯,৭৪৮) প্রাপ্তি হয়েছে কংগ্রেসের। ফলে অন্যান্যদের ভোটও পেয়েছে কংগ্রেস। এমনকি নোটায়-পড়া ভোটও এ বার ৩৬৮টি কম। যা থেকে বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভোটারেরা সচেতন ভাবেই শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বিজেপির ভোট কমে যাওয়াটাও পদ্ম শিবিরের পক্ষে ‘খারাপ খবর’। যা থেকে এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, আগে যাঁরা বাম এবং কংগ্রেস শিবির থেকে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা বিজেপির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তাই তাঁদের ভোট আবার বাম এবং কংগ্রেসে ফিরে এসেছে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রসঙ্গত, বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস আলাদা লড়েছিল। কিন্তু সেখানেও বামেদের ভোট বেড়েছিল। তার আগে ওই আসনে বামেদের ভোট ছিল ৫ শতাংশ, ওই উপনির্বাচনে তা বেড়ে হয়েছিল ৩০ শতাংশের মতো। যদিও তৃণমূল ওই ভোটে জিতেছিল। কিন্তু তাদের ভোটের শতাংশ ৭১ থেকে কমে হয়ে গিয়েছিল ৪৯। বিজেপির ভোট ২১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছিল ১৩ শতাংশ। কংগ্রেস দাগ কাটার মতো কিছুই করতে পারেনি। এরই পাশাপাশি রাজ্যের পুরভোটেও বামেদের ভোট বেড়েছে। সারা রাজ্যে বামেরা একটি হলেও পুরসভার দখল ধরে রাখতে পেরেছে।
সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে পার্থকাণ্ডের পর প্রথম ভোটে সাগরদিঘিতে যা ফলাফল হয়েছে, তাতে শাসক শিবিরের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এই ধারা বজায় থাকলে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে আরও ঘাম ঝরাতে হবে তৃণমূলকে।
সাধারণ ভাবে উপনির্বাচনে কম ভোট পড়ে। কিন্তু সাগরদিঘির ক্ষেত্রে সেই পরিমাণ কমেছে সামান্যই। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে মোট ভোট পড়েছিল ১,৮৬,৮১৬টি। আর উপনির্বাচনে ১,৮৫,০১২টি। ভোট কম পড়েছে মাত্রই ১,৮৯৪টি। একই ভাবে ভোট প্রাপ্তির হার থেকে বোঝা যাচ্ছে, সাগরদিঘিতে ভোট কাটাকাটির অঙ্ক তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটাই ভাবাচ্ছে তৃণমূলকে। হিসাব যা বলছে, তাতে সাগরদিঘিতে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ ভোট হয়েছে। মানুষ যেন এককাট্টা হয়ে তৃণমূলকে হারাতে চেয়েছে। সেটা মানছেন তৃণমূলের নেতাদের একটা অংশও।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সাগরদিঘির ভোটের ফলাফলে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। এই কেন্দ্রে পোস্টাল ব্যালট মোট ১৩০টি। এর মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৫০টি। কংগ্রেস পেয়েছে ৫৬টি এবং বিজেপি ২২টি। বাকি ২টি অন্যান্যেরা। সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, পোস্টাল ব্যালটের ভোট যে হেতু সরকারি কর্মচারীরা দেন, তাই তা শাসকের ঝুলিতেই আসে। কিন্তু সাগরদিঘিতে অর্ধেকেরও কম পোস্টাল ব্যালট গিয়েছে শাসক তৃণমূলের পক্ষে। যা থেকে মনে করা হচ্ছে, বকেয়া মহার্ঘভাতার (ডিএ) দাবিতে আন্দোলন এবং মামলার ‘প্রভাব’ পড়েছে সাগরদিঘির ফলাফলে। কুণাল অবশ্য সেটা পুরোপুরি মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‘ডিএ নিয়ে দাবিদাওয়ার জন্য ভোট কমেছে, এটা পুরোপুরি বলা যাবে না। কারণ, সরকারি কর্মচারীদের পরিবারে রাজ্যের অন্যান্য প্রকল্পের সুবিধা গিয়েছে। বরং, এটা ঠিক যে, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তের প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, এর মধ্যে সাধারণ মানুষের চাকরি, শিক্ষা, টাকা অনেক কিছু জড়িয়ে রয়েছে।’’ একই সঙ্গে কুণালের দাবি, ‘‘অনৈতিক জোট যে হয়েছে সেটাও ঠিক। ফলঘোষণার আগেই সেটা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তা জানার পরেও দলের পক্ষে কেন মোকাবিলার কথা ভাবা হল না, তা জানতেও আত্মসমীক্ষা করা দরকার।’’