বিশ্বভারতীর চীনা ভবনে আলোচনা সভায় অমিতেন্দ্রনাথ। নভেম্বর, ২০১৭। ফাইল চিত্র।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (লাঠি হাতে) সঙ্গে অমিতেন্দ্রনাথ (একেবারে ডানদিকে)। ছবি মিতেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে।
চলে গেলেন অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গোটা শান্তিনিকেতন জুড়ে যেন স্বজনহারার বেদনা। শান্তিনিকেতনের একান্ত আপন ‘বীরুদা’, বিশ্বভারতীর বিশিষ্ট প্রাক্তনী অমিতেন্দ্রনাথ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র। চিনা ভাষা চর্চার দিকপাল অমিতেন্দ্রনাথ বার্ধক্যজনিত কারণেই রবিবার কলকাতার সল্টলেকে নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর। এমনিতে সুস্থ সবল থাকলেও গত কয়েক মাস তিনি নিজে নিজে হাঁটতে পারছিলেন না বলে জানান তাঁর ভাইপো মিতেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯২২ সালের ৯ অক্টোবর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম অমিতেন্দ্রনাথের। জীবনের একটা বড় সময় আমেরিকায় অধ্যাপনা করে কাটালেও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। তিনি বিশ্বভারতীর ‘চীনা ভবনে’ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা দুইই করেছেন। ‘চীনা ভবনে’ তাঁর শিক্ষার শুরুর কথা বলতে গিয়ে মিতেন্দ্রবাবু বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় জাপানিরা বোমা ফেললে, নিরাপত্তার খাতিরে শান্তিনিকেতনে চলে আসে বীরুকাকার পরিবার। ততদিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি কম পাশ করে গেছেন। একদিন মেলার মাঠে তিনি ক্রিকেট খেলতে গেলে মাঠের বাকিরা জানায় এখানকার পড়ুয়া না হলে তিনি খেলতে পারবেন না। এরপরই নব নির্মিত চীনা ভবনে পড়ুয়া হিসেবে তার অন্তর্ভুক্তি।”
বাকিটা ইতিহাস। চীনা ভবনে স্নাতক স্তরের অধ্যয়ন শেষ করে তিনি চিনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর এক বছর ‘চীনা ভবনে’ অধ্যাপনার পর, ভারত-চিন দ্বন্দ্বের সূত্রে দেহরাদূন এবং পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতেও চিনা ভাষার পাঠ দিয়েছিলেন তিনি। এরপর এক বছরের জন্য আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে তিনি আবারও ফিরে আসেন ‘চীনা ভবনে’। লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। ১৯৬৬-১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অবসরের পর পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন কলকাতায়।
‘অমিত কথা’ নামে তাঁর একটি আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়েছে, যার অনুলিখন করেছেন মিতেন্দ্রবাবু। ছেলেবেলা থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন এবং আমেরিকার বহু স্মৃতি লিপিবদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থে। এ ছাড়াও ‘এক সূত্রের সন্ধানে’ গ্রন্থে ‘শান্তিনিকেতনের স্মৃতি’ প্রবন্ধে অমিতেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের সেকাল ও একাল নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। শান্তিনিকেতন জুড়ে তপোবনের চরিত্রের অবলুপ্তি এবং রাবীন্দ্রিক আদর্শের অভাব যে তাঁকে ব্যথিত করত, তা এই প্রবন্ধে স্পষ্ট প্রতিভাত। চিনা ভাষা চর্চার পাশাপাশি গল্ফ খেলা নিয়েও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। আমেরিকা থেকে ফিরে এসেও তিনি নিয়মিত কলকাতায় গল্ফ খেলতেন। শান্তিনিকেতনের সকলেই জানাচ্ছেন, অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণে শান্তিনিকেতন চিনা ভাষার এক প্রকৃত পণ্ডিত তথা বিশ্বভারতীর এক আপনজনকে হারাল।