গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণা হয়েছে গত ৪ জুন। বাংলায় বিজেপিকে আগের বারের থেকে কমিয়ে, সিপিএম-কংগ্রেসকে কার্যত দুরমুশ করে ২৯টি আসনে জিতেছে তৃণমূল। কিন্তু তার পর থেকে অন্তত পাঁচটি ঘটনায় শাসকদল ‘বিড়ম্বিত’। কখনও তা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে, কখনও তা রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক বিষয়ে। কোনও ক্ষেত্রে এক পা এগিয়েও দু’পা পিছিয়ে আসতে হয়েছে। কোনওটিতে সংশ্লিষ্টদের কড়া সমালোচনা করে ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্ব। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন বিরোধী পরিসরের আন্দোলন কোথায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিরোধী শিবিরের নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, নির্বাচনের ‘ধাক্কা’ এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। রাস্তায় নামা তো দূরের কথা, অনেকে সমাজমাধ্যমেও সরাসরি তৃণমূল-বিরোধিতার পথে হাঁটতে কুণ্ঠা বোধ করছেন। সেখানে তৃণমূল আগেভাগে নিজেরা ময়দানে নেমে বিরোধীদের পরিসরকে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে বলেও অভিমত অনেকের।
ঘটনা ১: আবাসনে অশান্তি
লোকসভা ভোটের ফলঘোষণার দিনই উল্টোডাঙার একটি বেসরকারি আবাসনে স্থানীয় তৃণমূলের লোকজন কয়েকশো অটো নিয়ে ঢুকে পড়েছিল। তারস্বরে বাজানো হয়েছিল ডিজে। যথেচ্ছ সোডার বোতল ভাঙারও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনাচক্রে, ওই আবাসনের বুথে লোকসভা ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। অভিযোগ, ‘বদলা’ নিতেই ওই তাণ্ডব চালিয়েছিল স্থানীয় তৃণমূলের লোকজন। যে ঘটনার ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর কলকাতার তৃণমূল নেতৃত্বকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দলের বৈঠকে। তার পর মমতার নির্দেশেই স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তিরঞ্জন কুন্ডু এবং তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ গিয়ে ওই আবাসনে দুঃখপ্রকাশ করে এসেছিলেন।
ঘটনা ২: দখলদার উচ্ছেদ
ফুটপাথ দখল নিয়ে নবান্নের প্রশাসনিক বৈঠক থেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ফুটপাথ দখলমুক্ত করার মমতার নির্দেশের পর রাজ্য জুড়ে বুলডোজ়ার নেমেছিল। গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল একের পর এক ‘বেআইনি’ দোকান। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজ়ার চালানোর প্রশাসনিক কায়দার সঙ্গে মমতার সিদ্ধান্তের তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদল করে মমতা এক মাস সময় বেঁধে দেন প্রশাসনকে। এবং এ-ও বলেন, ‘‘কাউকে বেকার করার অধিকার আমার নেই।’’ তবে রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, সরকারি জায়গা যে দখলমুক্ত করতে হবে, তা-ও বলেছেন তিনি। কিন্তু রুটিরুজির বিকল্প ব্যবস্থা করার পদক্ষেপও করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম দিন যে ‘আগ্রাসী’ মেজাজ দেখিয়েছিলেন প্রশাসক মমতা, পরের দিন তেমন ছিল না।
চোপড়ার ‘জেসিবি’
গত ৩০ জুন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তাঁর এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে চোপড়ার তৃণমূল নেতা তাজিমুল হক ওরফে ‘জেসিবি’র ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন। দেখা যায়, এক যুগলকে রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছেন জেসিবি। যিনি চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল ইসলামের ‘ঘনিষ্ঠ’। সেলিমের পরে বিজেপির অমিত মালবীয়ও ওই একই ভিডিয়ো পোস্ট করে লেখেন, ‘‘মমতার বাংলায় তালিবানি শাসন কায়েম হয়েছে।’’ এ নিয়ে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন হামিদুলের একটি বক্তব্য আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জেসিবি গ্রেফতার হয়েছেন। হামিদুলকে শোকজ় করেছে তৃণমূল। পাশাপাশিই, যে মহিলাকে ফেলে জেসিবি পিটিয়েছিলেন, তিনি সেলিম এবং মালবীয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন। যাকে সিপিএম এবং বিজেপি বলেছে ‘চাপ’ দিয়ে করানো।
গণপিটুনি এবং মৃত্যু
ছেলেধরা বা চোর— বিবিধ সন্দেহে রাজ্যে গণপিটুনি কার্যত সংক্রমণের আকার নিয়েছে। শুধু মার নয়। তারকেশ্বর থেকে ভাঙড়, বারাসত থেকে মেদিনীপুর— গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সমালোচকদের অনেকেই গোটা পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনকেই দায়ী করছেন। গত এক মাসে অন্তত ১৭টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে।
জায়ান্ট-জয়ন্ত
কামারহাটির আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংহ আপাতত খবরে। এলাকার এক মা-ছেলেকে পেটানোর ঘটনায় জয়ন্তের নাম সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রকাশ্যে আসে। কয়েক দিন পরে জয়ন্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেলে থাকা জয়ন্তের একাধিক পুরনো ঘটনার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। ‘জয়ন্ত’ কী ভাবে ‘জায়ান্ট’ হয়ে উঠলেন, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেরই দাবি, তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের ‘আশীর্বাদেই’ জয়ন্তের উত্থান। যদিও মদনের দাবি, তিনি জয়ন্তদের গুন্ডামি নিয়ে বারংবার পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে বলেছে, সাংসদ সৌগত রায় সবটা জানেন। সৌগত অবশ্য গোটা পর্বে নীরবে রয়েছেন।
কেন নেই বিরোধী আন্দোলন?
রাজ্য বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘‘এখন আন্দোলন বলতে সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেওয়া এবং সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা। সংগঠিত ভাবে সেই আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। সে কারণেই তৃণমূল ফাঁকা মাঠ পেয়ে যাচ্ছে।’’ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের অনেক কর্মী ঘরছাড়া। তাঁদের নানান ভাবে আমাদের সাহায্য করতে হচ্ছে। ফলে পারিপার্শ্বিক কারণেই সেই মাত্রায় আন্দোলন হয়তো হচ্ছে না, তবে মানুষ মনে মনে তৃণমূলের প্রতি ঘৃণাই পোষণ করছেন।’’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘নিচুতলা থেকেই আন্দোলন গড়ে তুলে জড়তা কাটাতে হবে। বৃহস্পতিবার তাই বামফ্রন্ট, ফ্রন্টের বাইরের বামদল এবং কংগ্রেস মিলে কামারহাটি থানা অভিযানের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। একই দিনে কলকাতা পুরসভার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে হকারদের যৌথ মঞ্চ। ফলে আন্দোলন হচ্ছে না, এটা বলা সত্যের অপলাপ।’’ কংগ্রেস নেতা সৌম্য আইচ রায়ও ভোট-পরবর্তী পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই দায়ী করেছেন। তবে তাঁরও বক্তব্য, ‘‘প্রতিটি ঘটনাতেই স্থানীয় স্তরে প্রতিবাদ হচ্ছে।’’ কিন্তু সেই প্রতিবাদের ‘অভিঘাত’ কতটা, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।
শাসকদল তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের ব্যাখ্যা, মূলত দু’টি কারণে বিরোধীরা আন্দোলন করার সুযোগ পাচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম যদি জেসিবি বা জয়ন্তদের সমালোচনা করতে যায়, তা হলে লোকে বলবে বাম আমলেও এই মাতব্বরি বাংলায় চলত। বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যেও চলে। ফলে তৃণমূলের আমলে নতুন জিনিস হচ্ছে বললে মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। দুই, সিপিএম জমানায় এই সব কাণ্ড ঘটানো নেতারা দলের কমিটিতে থাকতেন। বিজেপি শাসিত রাজ্যে গুন্ডারাই মন্ত্রী, বিধায়ক। আর তৃণমূল শুধু কড়া প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না, সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনিক পদক্ষেপও করছে। সংগঠন, প্রশাসন সমান্তরাল ভাবে শুদ্ধিকরণ চালাচ্ছে। আড়াল করছে না।’’
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৫টি আসন জিতেছিল বামফ্রন্ট। তৃণমূল পেয়েছিল সাকুল্যে ৩০টি আসন। যে সংখ্যা নিয়ে বামেদের আস্ফালন এবং তৃণমূলের প্রতি তাচ্ছিল্য কম ছিল না। কিন্তু ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন মমতা। তার পর থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাংলায় কী কী ঘটেছিল, তা ইতিহাস। রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, বিরোধী শিবিরে আন্দোলনের ‘ঝাঁজ’ তৈরি করার সেই ‘মুখ’ও নেই। সকলেই এখনও নির্বাচনী ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত। এক বিজেপি নেতা সামগ্রিক ভাবে বিরোধী শিবিরের সম্পর্কে খানিক কটাক্ষ করেই বলেছেন, ‘‘আমরা এখন হতাশা কাটানোর সাংগঠনিক কাউন্সেলিংয়ে ব্যস্ত। সে সব মিটলে দেখা যাবে!’’ আবার তৃণমূলের অনেকে এ-ও মানছেন, ‘‘বিভিন্ন ঘটনার ভিডিয়ো, ছবি জনমানসে যে ক্ষত তৈরি করছে, তাতে বিরোধীরা এখনও নিষ্ক্রিয় রয়েছে বলেই তাকে লঘু করে দেখা ঠিক হবে না।’’
তবে তৃণমূল ‘বিড়ম্বিত’ হলেও ‘উদ্বিগ্ন’ নয়। বিরোধী আন্দোলনই নেই যে!