গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বারাসত, অশোকনগর, খড়দহ, বনগাঁ, গাইঘাটা। গত কয়েক দিনে একের পর এক গণপিটুনির খবর রাজ্যবাসীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৯ সালের কথা। সে বার লোকসভা নির্বাচনের পরে পরেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে গণপিটুনির খবর মিলতে থাকে। এ বারের মতো সে বারেও নাবালক থেকে ভবঘুরে, জনরোষের শিকার হতে হয়েছিল অনেককে। কখনও ‘চোর’, কখনও ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে বা কখনও ‘ডাইনি’ অপবাদে গণপিটুনির ঘটনা এ রাজ্যে প্রায়শই শোনা যায়। সে সব রুখতে ২০১৯ সালে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বিল এনেছিলেন। ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং) বিল, ২০১৯’ পাশ হয়ে গিয়েছিল সেই বছরের অগস্ট মাসেই। সেই বিলে গণপিটুনিতে মৃত্যু হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও সে বিল আইনে পরিণত হয়নি। আটকে রয়েছে লালফিতের ফাঁসে। আইন বানাতে রাজভবনের প্রয়োজনীয় সই মেলেনি এখনও।
গণপ্রহার সারা দেশেই একটি বড় সমস্যা। কখনও রাজনৈতিক কারণে, কখনও ধর্মীয় কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওই ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকে। তবে মৃত্যু হলে হইচই হয়। নচেৎ নয়। গুরুতর জখম হলেও নয়। কিন্তু গণপ্রহারে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়ার উদাহরণও অনেক। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে দোষীদের জন্য আইন থাকলেও তাতে যে কাজের কাজ হয় না, তা জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী কল্লোল বসু বলেন, ‘‘আইন থাকলেই তো হবে না। বিচারপ্রক্রিয়ায় সাজার নজিরও চাই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের যে ন্যায়সংহিতা হয়েছে, তাতে গণপ্রহারকে মারাত্মক অপরাধ বলে দেখা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গোটা দেশে যত অভিযোগ, তার বিচার করার মতো বিচারক রয়েছেন কি? বিচারব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন না করতে পারলে কোনও আইনেই কিছু হবে না। দোষীরা পার পেয়ে যাবে।’’ একই সঙ্গে কল্লোল মনে করেন, ‘‘১৯৭৩ সালের ১৪৯ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে পুলিশের কাজ, অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সেটা নিশ্চিত করা। এমন অনেক ধারা, অনেক আইন রয়েছে। কিন্তু বিচার ঠিকমতো না হলে, অপরাধ ও বিচারক সংখ্যার তারতম্য না হলে সব আইনই প্রপঞ্চময় মায়া হয়ে থেকে যাবে।’’
কেন্দ্রীয় সরকার এবং সব রাজ্য সরকার যাতে গণপ্রহার রুখতে কড়া পদক্ষেপ নিশ্চিত করে, সে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টও দিয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্র এবং কয়েকটি রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট তলব করে বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি জেপি পারদিওয়ালাকে নিয়ে গঠিত শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ। সেই বছরেরই ডিসেম্বরে লোকসভায় দণ্ডসংহিতা সংক্রান্ত বিল নিয়ে বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘‘নতুন আইনে গণপিটুনির সাজা হিসাবে দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও বিধি রাখা হয়েছে।’’
তবে সেই বিধির কথা তারও আগে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। একটি গণপ্রহারের মামলায় শুনানির সময়ে দেশের সব ক’টি রাজ্যকে ‘সুসংহত পদক্ষেপ’ করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই পৃথক আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য। গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের সংস্থান রাখা হয়েছে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং) বিল, ২০১৯’-এ। বিলের বিরোধিতা করেনি বিরোধীরা। সর্বসম্মত ভাবে বিল পাশ করার আবেদন জানাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছিলেন, ‘‘গণপ্রহারে মৃতের পরিবারকে সরকারি চাকরি এবং অন্তত পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ভাবনাও রয়েছে।’’
কিন্তু দেখা যায়, বিধানসভায় বিধায়কদের মধ্যে বিলি করা বিলটিতে শাস্তি হিসেবে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ বলা রয়েছে। আবার বিধানসভায় পেশ হওয়া বিলে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বলে উল্লেখ রয়েছে। বিরোধী নেতারা ওই ‘অসঙ্গতি’ নিয়ে সরব হন। বিল ছাপা হয়ে আসার পরে তাতে কোনও পরিবর্তন বা সংযোজন দরকার হলে সাধারণত সভায় সংশোধনী পেশ করে সরকারপক্ষ। নতুন বিল এলে আগে বিলি করা বিলটি তুলে নেওয়া হয়। সরকারি নথিতে প্রথম ও পরের বিলের খতিয়ানও (মেমো নম্বর) আলাদা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল আগের এবং পরের বিলের মেমো নম্বর এক। দ্বিতীয়টিতে মৃত্যুদণ্ডের সংস্থান রয়েছে।
কংগ্রেস ও বামেরা প্রশ্ন তোলায় শাসকদলের তরফে বিষয়টিকে ‘ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি’ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় তা মানতে রাজি হননি। একই বিলের দু’টি বয়ান কেন, সেই প্রশ্ন তুলে সেটির অনুমোদন আটকে দেন ধনখড়। তাঁর প্রশ্নের জবাবে সরকার বিষয়টিকে ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ (অপটিক্যাল ইলিউশন) বলে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু ধনখড় তাতে সন্তুষ্ট হননি। ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হয়েছেন। রাজ্যে নতুন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এসেছেন। কিন্তু লালফিতের ফাঁসে আটকে থাকা বিলটি আর আইন হয়ে ওঠেনি।
বিধানসভায় তৎকালীন বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সরকারপক্ষ বেআইনি কাজ করেছিল। আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সতর্কও করেছিলাম। কিন্তু বিরোধী দলের কথা শোনা হয়নি। তাই আমরা রাজ্যপালকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। সব ইতিবাচক ক্ষেত্রে যেমন রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব থাকে, তেমন এ ক্ষেত্রেও ছিল।’’ অন্য দিকে, পরিষদীয়মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গণপ্রহারের বিল এখনও রাজভবনে আটকে আছে। রাজভবন বিলটিতে সায় দিলেই রাজ্য সরকার তা কার্যকর করবে।’’
কেন্দ্রের নতুন আইন কার্যকর হবে ১ জুলাই। ভারতে গণপ্রহারের মতো অপরাধের জন্য আলাদা করে আইন নেই। ৩০২ ধারায় খুন বা ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টার অভিযোগেই বিচার হয়। আইনজীবী অপলব বসুর কথায়, ‘‘সুনির্দিষ্ট করে আইন না থাকলেও এই ধরনের অপরাধের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সেগুলিই প্রযোজ্য হয়। আর ভারতে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সাজা, এমন করে কিছু বলা যায় না। অতীতে ৩০৩ ধারায় বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড বলা থাকলেও সেটিকে এখন অসাংবিধানিক হিসাবে ধরা হয়।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘অনেক সময়ে গণপ্রহারের শিকার আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ৩০৭ ধারায় মামলার পাশাপাশি ৩২৬ ধারাতেও যাবজ্জীবন কারাবাসের মতো সাজা হতে পারে।’’