বেহালায় পথদুর্ঘটনায় নিহত স্কুলপড়ুয়া সৌরনীল সরকার (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
বেহালায় ছাত্রমৃত্যুর পরের দিনই একই ঘটনার প্রায় পুনরাবৃত্তি হল নদিয়ায়। শনিবার পলাশিপাড়ার কুলগাছিতে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম রবিউল শেখ। ১২ বছরের ওই ছাত্রটি রাজ্য সড়কে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময়ে একটি পিক-আপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছাত্রটির। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। পুলিশকে ঘিরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয়েরা। অন্য দিকে, বেহালার ঘটনাকে ঘিরে যে জনরোষ তৈরি হয়েছিল, তা সামলাতে জোড়া পদক্ষেপ করেছে কলকাতা পুলিশ। এক দিকে জোর দিয়েছে ট্র্যাফিক ব্যবস্থায়। অন্য দিকে, শুক্রবার সকালে দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে পুলিশের উপর ‘হামলা চালানো’ বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বার করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
বেহালার ঘটনায় জনতা অভিযুক্ত লরিচালকের শাস্তি দাবি করেছিল। শুক্রবারই ওই লরির চালক এবং খালাসিকে গ্রেফতার করা হয়। এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় মোট ৩২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বেহালার ঘটনার পর ট্র্যাফিক পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। বেহালার ঘটনায় মৃত ছাত্র বড়িশা হাই স্কুলে পড়ত। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাত্রের মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “পুলিশ যদি সচেতন থাকত, আমার ছেলেটাকে হারাতাম না।” পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা এবং বৈষম্যের অভিযোগ তুলে তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, “পাশে অন্য বেসরকারি স্কুলের সামনে ট্র্যাফিক পুলিশ থাকে, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু আমাদের স্কুলের সামনে থাকে না। আমাদের স্কুলে চার চাকা নিয়ে কেউ পড়তে আসে না। আসে সাইকেল নিয়ে। এই স্কুল থেকে অনেকের সাইকেল চুরি হয়েছে অতীতে, চোর ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’ শনিবার অবশ্য ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাদের তরফে বলা হয়েছে, ব্যস্ত ডায়মন্ড হারবার রোডের একাধিক জায়গায় ‘ড্রপ গেট’ এবং পুলিশি ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। মূলত ফুটপাত এবং রাস্তার সংযোগস্থল— যে জায়গা দিয়ে পথচারীরা রাস্তা পারাপার করেন, সেখানে এই ‘ড্রপ গেট’ লাগানো হয়েছে। তবে এই বন্দোবস্ত কত দিন থাকবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
বেহালার পুনরাবৃত্তি নদিয়ায়
পলাশিপাড়ার কুলগাছিতে বেতাই-পলাশিপাড়া রাজ্য সড়কে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ বছরের কিশোর রবিউল শেখ। সেই সময় একটি পিক-আপ ভ্যান তাকে ধাক্কা মারে। স্থানীয়েরা তড়িঘড়ি রবিউলকে উদ্ধার করে পলাশিপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে তাদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখানো শুরু হয়।
বেহালায় ট্র্যাফিক-তৎপরতা
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় এখনও চাপা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, এত দিন ধরে একে বারেই পুলিশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল না বেহালার ডায়মন্ড হারবার রোডে। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনার কারণেই পুলিশ হঠাৎ করে এত তৎপর হয়ে উঠেছে বলে দাবি তাঁদের। বেহালা চৌরাস্তা সংলগ্ন ব্যস্ত ডায়মন্ড হারবার রোডের জায়গায় জায়গায় ড্রপ গেট এবং ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। মূলত ফুটপাত এবং রাস্তার সংযোগস্থলে যে জায়গা দিয়ে পথচারীরা রাস্তা পারাপার করেন, সেখানে ড্রপ গেট লাগানো হয়েছে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় বন্ধ থাকছে ড্রপ গেট। পুলিশকর্তারা মনে করছেন, ড্রপ গেটের ব্যবহার সঠিক ভাবে করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে। শনিবার সকাল থেকেই বেহালা চৌরাস্তার কাছে চতুর্দিকে পুলিশের ছড়াছড়ি। অতিরিক্ত পুলিশি তৎপরতায় গতি কমিয়ে চলাচল করানো হচ্ছে আলিপুর এবং ঠাকুরপুকুরগামী যানবাহন। সিগন্যাল লাল হওয়ার পর গাড়ির গতিবিধি এবং রাস্তা পারাপার করা জনতার দিকেও থাকছে নজর। কিন্তু স্থানীয়দের একাংশের প্রশ্ন, বেহালার স্মৃতি সকলে ভুলে যাওয়ার পরেও এই বন্দোবস্ত থাকবে তো?
২৪ ঘণ্টায় আরও তিন দুর্ঘটনা
বেহালার পর রাজ্যে আবার পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু। তিনটি দুর্ঘটনায় মোট পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে ওঠার মুখে লরির ধাক্কায় মৃত্যু হয় এক তরুণীর। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় দু’টি দুর্ঘটনায় এক পুলিশকর্মী-সহ চার জনের মৃত্যু হয়। জখম হন কয়েক জন। রাজ্য সরকারের ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচির পরেও বার বার পথ দুর্ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে।
পুলিশ কমিশনার যা জানালেন
শনিবার সকালে পথ নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বেহালার বড়িশা হাই স্কুলের সামনে আসেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। শুক্রবারের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রাত থেকেই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি নিজে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছি। এর পর দেশের অন্যান্য মহানগরের ট্র্যাফিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা টেনে বলেন, “দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতার মধ্যে তুলনা করে দেখে নিন। সব থেকে ভাল পথ নিরাপত্তা রয়েছে কলকাতাতেই। সব সময় গাড়িচালকের ভুল থাকে না। পথচারীদেরও ভুল থাকে। তাই পথচারীদের মধ্যেও সচেতেনতা বাড়াতে হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বড় রাস্তা পার হওয়ার সুবিধার্থে রাস্তার মাঝে আমরা একটা করে আইল্যান্ড করে দেব । যাতে মানুষ মাঝখানে এসে দাঁড়াতে পারে। সচেতনতা এক রাতে আসে না। সময়ের সঙ্গে আসে। মানুষ যদি পুলিশকে সহায়তা না করে, তা হলে হবে না। কিছু মানুষ এখনও সহায়তা করছেন না। আগের বছরগুলির রেকর্ড দেখতে হবে। তা হলেই বোঝা যাবে দুর্ঘটনা বেড়েছে না কমেছে।’’
অতিরিক্ত ব্যারিকেডেই কি দুর্ঘটনা
কলকাতার রাস্তায় গাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করেন যাঁরা, তাঁদের একাংশের মতে, কলকাতায় পথ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশের লাগানো গার্ডরেল এবং ব্যারিকেড। তাঁদের দাবি, পুলিশের তরফে পথ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এত ব্যারিকেড এবং গার্ডরেল লাগানো হয়েছে যে, তাতে দুর্ঘটনা বাড়ে বই কমে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতার এক গাড়িচালক বলেন, ‘‘রাতে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির গতি একটু বেশি থাকে। কিন্তু রাস্তায় গার্ডরেল এমন ভাবে রাখা থাকে যে, তাতে দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়ে। প্রচণ্ড ঝড়ের সময়েও গার্ডরেল সরে গিয়ে বিপত্তি বাড়তে পারে।’’ অন্য একটি অংশের অবশ্য দাবি, শহরে গাড়ির গতিবেগ যে গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা হয়েছে, তাতে এমন দুর্ঘটনা ঘটারই কথা নয়। তাঁদের আরও দাবি, কলকাতার গাড়ির গতিবেগ মুম্বই, দিল্লির মতো বড় শহরগুলির তুলনায় অনেকটাই কম। মা উড়ালপুল এবং রেড রোডের মতো রাস্তায় গতিবেগ ঘণ্টা প্রতি ৩৫-৬০ কিলোমিটারে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চলে ধীর গতিতে।
শুক্রবার বেহালায় যা হয়েছিল
শুক্রবার সকালে লরির ধাক্কায় স্কুলছাত্রের মৃত্যু ঘিরে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধে বেহালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ মাটিবোঝাই একটি লরি তীব্র গতিতে এসে ধাক্কা মারে প্রাথমিকের পড়ুয়া সৌরনীল সরকার এবং তার বাবাকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই খুদে পড়ুয়ার। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তার বাবাকে। পরে তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ঘটনা ঘিরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বেহালা। দেহ রাস্তায় ফেলে রেখে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়েরা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের ভ্যানে। বেশ কয়েকটি সরকারি বাস ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি সামলাতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। বেহালার ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রে জানা যায়, কলকাতা পুলিশের ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচির মধ্যে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে ফোন করে তা জানতে চান তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই শুক্রবার সকালে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেন মুখ্যসচিব। বেহালার ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবরও নেন তিনি।