কমিশনের সিদ্ধান্ত জানার পরেই আদালতে যাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে তৃণমূল । — ফাইল চিত্র।
সোমবার জাতীয় নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, তৃণমূল আর জাতীয় দল নয়। একই সঙ্গে জাতীয় দলের তকমা হারিয়েছে বাম দল সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া) এবং মহারাষ্ট্রের নেতা শরদ পওয়ারের এনসিপি (ন্যাশানালিস্ট কংগ্রেস পার্টি)। তাদেরও জাতীয় দলের তকমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্য দিকে, অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ) পেয়েছে জাতীয় দলের মর্যাদা। ২০১৬ সাল থেকে কমিশন যে নতুন নিয়ম চালু করেছে, তাতে প্রতি দশ বছর অন্তর দেশের জাতীয় দলের তালিকা তৈরি হয়। সেই হিসাবে পরবর্তী তালিকা হবে ২০৩৩ সালে বা তার পরে। সেই নিয়মে বড় কোনও বদল না এলে আগামী দু’টি লোকসভা নির্বাচনে ‘আঞ্চলিক দল’ হিসাবেই ভোটে লড়তে হবে তৃণমূলকে। এই সময়ের মধ্যে জাতীয় দল হওয়ার শর্তপূরণ করতে পারলেও তকমা কিন্তু অধরাই থেকে যাবে।
তৃণমূল কমিশনের এই সিদ্ধান্ত জানার পরেই আদালতে যাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। দলের তরফে এখনও সে ভাবে সিদ্ধান্ত জানানো না হলেও তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় মঙ্গলবার আনন্দবাজার অনলাইকে বলেন, ‘‘দল এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বিষয়টা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’’ তৃণমূল কি এই বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হবে? সৌগত বলেন, ‘‘কিছুই ঠিক হয়নি। তবে যে কোনও দলেরই সব সময় সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার রাস্তা খোলা থাকে।’’ প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে সৌগত প্রায় নিশ্চিত করেই জানিয়েছিলেন, দল আইনের দ্বারস্থ হচ্ছেই। তিনি একটি চ্যানেলকে বলেছিলেন, ‘‘আমরা আদালতে গিয়ে আইনের পথে এর মোকাবিলা করব।’’
কিন্তু আদালতে গেলে কী যুক্তি দেবে তৃণমূল? এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি বাংলার শাসকদল। তবে সূত্রের খবর, একটি বিষয় নিয়ে আদালতে যাওয়ার ভাবনা আপাতত গুরুত্ব পাচ্ছে।
২০১৬ সালে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতি পাঁচ বছরের পরিবর্তে প্রতি দশ বছর অন্তর জাতীয় দলের নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৬ সালের অগস্ট মাসে। আর তৃণমূল জাতীয় দলের তকমা পায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেই হিসাবে ২০২৬ সালে পরবর্তী তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা ২০২৩ সালের এপ্রিলেই প্রকাশিত হল। অর্থাৎ, তৃণমূল মাত্র সাত বছর জাতীয় দল থাকার সুযোগ পেল।
কিন্তু এই যুক্তি নিয়ে তৃণমূল আদালতে যেতে পারবে কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ, সোমবার নির্বাচন কমিশন তৃণমূলের জাতীয় দলের তকমা চলে যাওয়ার যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তাতেই আদালতে যাওয়ার পথে কাঁটা বিছোনো রয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তৃণমূল জাতীয় দলের মর্যাদা পেলেও তা কার্যকর হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকেই। সেই হিসাবে তৃণমূলের জাতীয় দল থাকার দশ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
কেন ২০১৪ সাল থেকে তৃণমূল জাতীয় দল, তা-ও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা রয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের আগেই ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী বাংলার রাজ্য দলের মর্যাদা ছিল তৃণমূলের। এ ছাড়াও ২০০৯ সালের অরুণাচল বিধানসভা, ২০১২ সালের মণিপুর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে ওই দুই প্রদেশে রাজ্য দল হয়ে যায় তারা। এর পরে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ত্রিপুরাতেও রাজ্য দলের মর্যাদা পায় তৃণমূল। চারটি প্রদেশে রাজ্য দলের মর্যাদার শর্তপূরণ করাতেই মেলে জাতীয় দলের তকমা।
নির্বাচন কমিশনের আরও বক্তব্য, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত তৃণমূল নিজের জাতীয় দলের তকমা ধরে রাখার জন্য মোট ২১টি রাজ্যের বিধানসভা ভোট এবং একটি লোকসভা নির্বাচনে সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার জন্যই এখন আর তাদের জাতীয় দলের তকমা রইল না।
কমিশন তৃণমূলকে যে চিঠি পাঠিয়েছে, তার তৃতীয় অনুচ্ছেদে জাতীয় দলের তকমা চলে যাওয়ার যুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা রয়েছে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে অরুণাচল প্রদেশে রাজ্য দলের মর্যাদা খোয়ায় তৃণমূল। কিন্তু যে হেতু দলকে ২০১৪ থেকেই জাতীয় দলের তকমা দেওয়া ছিল, তাই কোনও বদল আনা হয়নি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ৩৪টি আসনে জিতলেও তৃণমূল যে রাজ্য দলের মর্যাদা পাওয়া অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর এবং ত্রিপুরায় একটিও আসন পায়নি, তা-ও তালিকা দিয়ে জানিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই চার রাজ্যের কোথায় কত শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল, তার তথ্যও দিয়েছে। তাতে উল্লেখ রয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা ছাড়া কোথাও ভোটে লড়েনি তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গে দল ৪৩.২৮ শতাংশ ভোট পেলেও ত্রিপুরায় পেয়েছিল ০.৪০ শতাংশ ভোট।
২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তৃণমূলের কাছে জাতীয় দলের তকমা ধরে রাখার জন্য কী কী সুযোগ ছিল, চিঠিতে তার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলায় ২০২১ সালে ২১৩ টি আসনে জিতলেও মণিপুরে কোনও আসন পায়নি তৃণমূল। কমিশন তৃণমূলকে জানিয়েছে, জাতীয় দলের তকমার সঙ্গে সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুরে রাজ্য দলের মর্যাদাও হারিয়েছে তারা।