হাসপাতালের পথে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
সরকারি হাসপাতাল নিয়মে চলে।
সেখানে বড়দের জন্য যে ব্যবস্থা শিশুদেরও তাই। রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুটির জন্যও তাই দু’বেলা ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ আসত। কেমো নিয়ে নিয়ে নেতিয়ে পড়া বাচ্চাটার মুখে সেই খাবার রুচত না। কিন্তু নাহ্, খাবারটা নষ্টও হত না। হাসপাতালের ওয়ার্ডে পড়ে থাকা মা আর বাইরে গাছতলায় দিন কাটানো বাবা ভাগাভাগি করে সেই খাবারই দু’বেলা খেতেন। আর বাকি সময়? ‘‘মুড়ি আর জল। আমাদের ওতেই চলে যেত। কোনও অসুবিধা হত না, বিশ্বাস করুন। কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না। গ্রামে ফিরে গিয়ে পুরনো কাজটাও ফেরত পাওয়া গেল না। এখন দু’বেলা খাবার জোগাড় করাই দুষ্কর।’’ ফোনে গলা বুজে আসে পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের দম্পতির। তাঁরা জানান, এক প্রতিবেশীর সন্তানের ক্যানসার ধরা পড়েছে মাস দুয়েক আগে। কিন্তু তাঁদের পরিস্থিতি দেখে ওই পরিবার আর শহরে এসে চিকিৎসা করানোর সাহস পাচ্ছে না। ‘‘ওরা বলছে, গুনিনের কাছে নিয়ে জলপড়া দেবে।’’
কখনও বিকল্প চিকিৎসা, কখনও তাবিজ-কবচ-জলপড়া, কখনও আবার ‘ভাগ্যের ভরসায়’ বসে থাকা। এ ভাবেই দিন কাটছে রাজ্যের অসংখ্য ক্যানসার রোগীর।
ক্যানসারে একটি পা বাদ গিয়েছে বর্ধমানের ১৩ বছরের স্বপ্না চৌধুরীর। বর্ধমান থেকে তাকে কলকাতায় আনতে অ্যাম্বুল্যান্সে খরচ প্রতি বার ২২০০ টাকা। কিন্তু যে দিন আসা, সে দিন হয়তো শুধু আউটডোরে ডাক্তারবাবু দেখলেন। তার পর পরীক্ষার জন্য আসতে হল আরও দু’দিন। তার পর কেমো। তার পর কিছু দিন রেডিয়োথেরাপি। সরকারি ফ্রি চিকিৎসা পেতে শুধু গাড়িভাড়া বাবদই পরিবারের খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
ক্যানসারে পা হারানো স্বপ্না চৌধুরী। নিজস্ব চিত্র
শুধু অ্যাম্বুল্যান্স নয়, অস্ত্রোপচারের সময়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি স্বপ্নার পরিবারকে বহু ওষুধ এবং সরঞ্জাম বাইরে থেকে কিনে দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ। বাবা সঞ্জয় ফুলের চারা বিক্রি করেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘বাজারে বিস্তর ধার আর লোকজনের দয়ার দানে মেয়েটার চিকিৎসা চলছে। কিন্তু যাতায়াতের এই টানাপড়েন আর নিতে পারছে না মেয়েটা।’’ ক্যানসার রোগীদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী অনুপ মুখোপাধ্যায় জানান, সরকারি হাসপাতালে বেশির ভাগ ক্যানসার রোগীরই স্টেজ টু, থ্রি বা ফোর। বায়োপসি রিপোর্ট পাওয়ার আগেই যে চিকিৎসা পর্ব, তাতেই ধারদেনা করে তাঁদের নাজেহাল অবস্থা। তিনি বলেন, ‘‘বিনা পয়সার চিকিৎসা ঠিকই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম কেমোর তারিখ পেতে অনেক সময় লাগে। একই ভাবে যে রোগীর পর দিন থেকে রেডিয়েশন শুরু হওয়া দরকার, তার তারিখ পাওয়া যায় দেড়-দু’মাস পরে। অনেক ক্ষেত্রে ছ’টা কেমোর মধ্যে একটা-দুটো বাইরে থেকে কিনতে হয়। এ ভাবেই চলছে।’’
নবদ্বীপের ইতুরানি কুণ্ডুর ডিম্বাশয়ের ক্যানসার। এসএসকেএমে একাধিক দফায় কেমোথেরাপি হয়েছে। তাঁর স্বামী রঙের মিস্ত্রি। মেয়ে রিয়া বললেন, ‘‘একাধিক কেমোর ওষুধ আমাদের বাইরে থেকে কিনে দিতে হয়েছে। কারণ, হাসপাতালে সাপ্লাই ছিল না।’’ গাড়িভাড়ার পাশাপাশি ওষুধের দাম মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার।
যাতায়াতের ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ আর কাজের দিন নষ্ট হওয়ায় আর্থিক লোকসান। ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে কলকাতায় আসার পথে মূল বাধা এগুলিই। প্রাক্তন সরকারি চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যানসার রোগীদের জন্য সমস্ত সরকারি পরিবহণ ফ্রি করা জরুরি। তা হলে যাতায়াতের চিন্তা অনেকটাই কমে। রেলে ছাড় পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ফর্ম ফিল আপ করতে হয়, যার প্রচুর ঝক্কি। সেই ঝক্কির ভয়ে অনেকেই আর আবেদন করেন না। নির্দিষ্ট কার্ড থাকলে সেই সমস্যা হবে না। পাশাপাশি, জেলা হাসপাতাল থেকে নিখরচায় শহরে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীরা যে দিন হাসপাতালে যাবেন, পরীক্ষাগুলো যথা সম্ভব যেন সে দিনই করা হয়, এই মর্মে সরকারি আদেশনামা জরুরি। এতে একাধিক দিন আসার হয়রানি কমবে।’’
আর এক প্রবীণ সরকারি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘যাঁরা দৈনিক পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজ করেন, চিকিৎসার জন্য তাঁদের কাজের দিন নষ্ট হয়। হাসপাতালের শংসাপত্রের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন থেকে চিকিৎসা চলাকালীন তাঁদের জন্য এককালীন ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চোলাই মদ খেয়ে মৃত্যু হলেও যেখানে ক্ষতিপূরণ মেলে, সেখানে ক্যানসার রোগী বা তাঁর সহায়ক কেন এই ভাতা পাবেন না, সেই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।’’
আর থাকা-খাওয়া? কলকাতায় এই মুহূর্তে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টালিগঞ্জ এবং লেকটাউনে দু’টি বাড়িতে ক্যানসার রোগী ও তাঁদের পরিবারের কম খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ‘‘বেসরকারি সংস্থা পারলে সরকার কেন পারবে না? প্রয়োজনে ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে’ এটা হতে পারে। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে তো প্রচুর ফাঁকা জমি রয়েছে। সেখানে কেন এই ধরনের রোগী ও পরিবারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না? অন্য রোগের সঙ্গে ক্যানসারকে গুলিয়ে ফেলা যায় না। মাথা গোঁজার আশ্রয় না দিলে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সরকার তো অর্থ ব্যয়ে কার্পণ্য করছে না। তা হলে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কেন এমন ঘাটতি?’’ প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক আমলা। যিনি একাধিক বার ক্যানসার রোগীদের এই শহরে থাকার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু বার বারই যা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে।