উত্তরাখণ্ডে আটকে পড়া সেই বাঙালি পর্যটকরা। নিজস্ব চিত্র
সফর শেষ হয়েই এসেছিল। কিন্তু সফর শুরুর সময়ে ২৭ বাঙালি সম্ভবত আঁচ করতে পারেননি যে, শেষরক্ষা হবে না। ২৪ মার্চ উত্তরাখণ্ডের কাঠগোদাম থেকে কলকাতার ট্রেনে চড়ার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্কটজনক হতে থাকায় ২২ মার্চ থেকে গোটা দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্রেন চলাচল। তার পরে ২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে কার্যকরী করা হয়েছে দেশজোড়া সম্পূর্ণ লকডাউন। ফলে বাঙালি পর্যটকরা আটকে পড়েছেন সাড়ে ছ’হাজার ফুট উচ্চতায়। প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পাহাড়ি জনপদ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্দেশে ‘এসওএস’ পাঠাচ্ছেন তাঁরা— দয়া করে উদ্ধার করুন।
১৩ মার্চ কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলেন এই বাঙালি পর্যটকেরা। গন্তব্য ছিল উত্তরাখণ্ডের একগুচ্ছ পর্যটনস্থল। নৈনিতাল, কৌসানী, মুন্সিয়ারি হয়ে তাঁরা পৌঁছেছিলেন পিথোরাগড় জেলার ছোট্ট, নিরিবিলি হিলস্টেশন চৌকোরিতে। কিন্তু তত দিনে গোটা বিশ্বে ত্রাস হয়ে উঠেছে করোনা। ভারতেও পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্কটজনক হচ্ছে। একের পর এক রাজ্য নিজেদের মতো করে লকডাউন, কার্ফু বা ১৪৪ ধারা জারি করতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে গোটা দেশ এক দিনের ‘জনতা কার্ফু’ও পালন করে ফেলেছে। সুতরাং রাজ্যে ফেরা যে কঠিন হয়ে উঠতে চলেছে, সে আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে থাকা বাঙালি পরিবারগুলোর মধ্যে। কিন্তু উপায়ান্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে।
ফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে আকুল আর্তি জানাতে শুরু করেছেন ওই ২৭ বাঙালি পর্যটক। স্থানীয় প্রশাসন আপাতত তাঁদের রিসর্ট-বন্দি থাকতে বললেও তাঁরা রাজ্যে ফিরতে মরিয়া। রাজ্য সরকারের কাছে তথা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নানা ভাবে সে আর্জি পৌঁছে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি এক পাহাড়ের মাথায় বসে।
এই রিসর্টেই আটকে ওই পর্যটকরা। নিজস্ব চিত্র
‘‘চৌকোরি খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু আমরা সমতলের মানুষরা কত দিন এই ভাবে পাহাড়ে কাটাতে পারব?’’— ফোনে অসহায় কণ্ঠস্বর ভেসে এল পর্ণিনী চট্টোপাধ্যায়ের। পর্ণিনীরা হাওড়ার বাসিন্দা। তাঁর বাবা এ. কে. চট্টোপাধ্যায় রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। তবে পর্ণিনীর পরিবারের চার জন বাদে দলের বাকিরা দুর্গাপুর-আসানসোল অঞ্চলের। পর্ণিনী বললেন, ‘‘এত দিনের জন্য আটকে পড়ব, সে কথা তো ভাবতেই পারিনি। সঙ্গে পর্যাপ্ত জামাকাপড় নেই। ঠান্ডাও বেশ প্রবল এখনও। সন্ধ্যার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। কখনও জল থাকছে না। কখনও কারেন্ট থাকছে না। এগুলো এই অঞ্চলে স্বাভাবিক। আমরা হয়তো কয়েক দিনের জন্য সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছি। কিন্তু লকডাউনের জন্য আগামী ২১ দিন যদি এই ভাবে আটকে থাকতে হয়, তা হলে সাঙ্ঘাতিক সমস্যায় পড়ে যাব।’’
আরও পড়ুন: বাড়ি বাড়ি বৃদ্ধাশ্রম, কী ভাবে কাটাচ্ছেন ওঁরা?
যে ২৭ জন আটকে পড়েছেন উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের হার্টের সমস্যা রয়েছে। শিশুও রয়েছে বেশ কয়েকটি। চৌকোরির ঠান্ডার মধ্যে আরও সপ্তাহ তিনেক আটকে থাকতে হলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে গোটা দলটাই। পর্ণিনী বললেন, ‘‘এখানে সে ভাবে দোকান-বাজারই নেই। লকডাউনের ফলে জিনিসপত্রের সাপ্লাই-ও কম। ওষুধের দরকার হলে তিন কিলোমিটার নীচে নামতে হচ্ছে। আবার উঠে আসতে হচ্ছে পাহাড়ি রাস্তা ধরে। ডাক্তার নেই। কেউ অসুস্থ হলে কী করব, কারও জানা নেই।’’
স্থানীয় প্রশাসন অবশ্য যোগাযোগ করেছে আটকে পড়া বাঙালি পর্যটকদের সঙ্গে। পিথোরাগড়ের এসডিএম মঙ্গলবারই চৌকোরির রিসর্টে গিয়ে কথা বলে এসেছেন। কারও কোনও সমস্যা হবে না, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস তাঁরা পাবেন, ওষুধের সরবরাহও অক্ষুণ্ণ থাকবে— এমন আশ্বাস দিয়ে এসেছেন ওই সরকারি কর্তা। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও ভাবেই যেন কেউ চৌকোরি ছাড়ার চেষ্টা না করেন— সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতেই কাতর আর্তি নবান্নের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন পর্ণিনীরা। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘এসডিএম যতই আশ্বাস দিন, আমাদের পক্ষে এত দিনের জন্য এই পরিবেশে আটকে পড়া কতটা কঠিন, সেটা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই আমরা চাইছি, কোনও ভাবে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবরটা পৌঁছক। তিনি যে ভাবে হোক আমাদের বাংলায় ফেরানোর ব্যবস্থা করুন।’’
আরও পড়ুন: করোনা ত্রাণে সাহায্য করুন, আর্জি মমতার
কিন্তু ফিরবেন কিসে? ট্রেন বা উড়ান, সবই তো বন্ধ। পর্ণিনী অসহায় ভাবে বলছেন, ‘‘অন্তত একটা বাসের ব্যবস্থা করে দিক। তাতেই চলে যাব আমরা। বাড়ি ফিরে গিয়ে ১৪ দিন কোথাও বেরব না, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব, কথা দিচ্ছি। কিন্তু যে করে হোক, আমাদের ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।’’ শারীরিক ভাবে তো বটেই, মানসিক ভাবেও অনেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করেছেন বলে জানাচ্ছেন পাহাড়ে আটকে থাকা ওই বাঙালি পর্যটকদের কেউ কেউ।
রাজ্য প্রশাসনের কাছে অবশ্য সে খবর এ দিন পৌঁছেছে। প্রশাসন সব রকম ভাবেই ওই পর্যটকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীও উদ্যোগী হয়েছে উত্তরাখণ্ডে আটকে পড়া এই বাঙালি পর্যটকদের সুরাহা করতে। চৌকোরিতে ২৭ জন বাঙালি পর্যটক আটকে রয়েছেন জেনেই অধীর চৌধুীরর অফিস থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পরে তাঁদের সমস্যার কথা পিথোরাগড়ের জেলাশাসকের দফতরকেও জানানো হয়। জানানো হয় উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিংহ রাওয়াতের দফতরকেও। ওই পর্যটকদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব জেলাশাসকের দফতর নিচ্ছে বলে অধীর চৌধুরীর অফিস সূত্রে জানা গিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের বাংলায় ফেরানোর ব্যবস্থা যাতে করা যায়, তার জন্যও উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে অনুরোধ পৌঁছেছে লোকসভার বিরোধী দলনেতার তরফ থেকে।