বেহাল: চিকিৎসকের অভাবে ধুঁকছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রই। ইনসেটে, মোমরেজগড়ের খবর আনন্দবাজারে। নিজস্ব চিত্র
হাতের কাছে হাসপাতাল। কিন্তু থাকলে কী হবে, চিকিৎসকই তো নেই। জনা চারেক নার্স আছেন। তাঁরা জ্বর-সর্দি-কাশির মতো কিছু সাধারণ সমস্যায় ওষুধপত্র দেন। কিন্তু কারও কোনও বাড়াবাড়ি হলে লোকে জানে, ছুটতে হবে ৮-১০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে। সেখানে যেতে আবার নদী পেরোতে হয়। ফেরি বন্ধ সন্ধে সাড়ে ৭টার মধ্যে!
এই পরিস্থিতিতে পল্লি চিকিৎসকদের রমরমা মৌসুনি পঞ্চায়েত এলাকায়। জনা পঞ্চাশ পল্লি চিকিৎসক চুটিয়ে কাজ করছেন বলে জানালেন এলাকার মানুষ। রাতবিরেতেও তাঁদের পাশে পাওয়া যায় বলে জানালেন।
ফ্রেজারগঞ্জ কোস্টালের মৌসুনি পঞ্চায়েতের বাগডাঙা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রায় তিরিশ বছর ধরে কোনও স্থায়ী চিকিৎসক নেই। এই পরিস্থিতিতে রোগীরাও বিশেষ ভিড় করেন না। আগে যেখানে দিনে আড়াইশো লোকের ভিড় হত, সেখানে এখন মেরেকেটে ৪০-৫০ জনের দেখা মেলে। সম্প্রতি জয়নগরের মোমরেজগড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্থায়ী চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তারপরে মৌসুনির বাসিন্দাদেরও আশা জেগেছে, এ বার হয় তো তাঁদের জন্যও কোনও ব্যবস্থা করবে সরকার।
এলাকার বাসিন্দা তথা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্য কমিটির চেয়ারম্যান শুভেন্দু মান্না বলেন, ‘‘বছর তিরিশ ধরে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও স্থায়ী চিকিৎসক নেই। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনও চিকিৎসক গ্রামীণ হাসপাতালে ৫ বছর চিকিৎসার পরে অন্যত্র যেতে পারেন। কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁরা আগেই চলে যাচ্ছেন। এখানে কোনও চিকিৎসকই থাকছেন না। ফলে দ্বীপের মানুষ প্রতি মুহূর্তে বিপদে পড়ছেন।’’
চিকিৎসক নিয়োগ নিয়ে জেলার এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক জন চিকিৎসককে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় প্রত্যেকেই একবার করে গিয়ে ফিরে আসছেন। আর যেতে চাইছেন না। তবুও নতুন চিকিৎসক পাঠানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
নামখানা ব্লকের এই পঞ্চায়েতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ১৯৭৬ সালে চালু হয়েছিল। শুরুতে ৬টি শয্যা-সহ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সকলেই ছিলেন। চিনাই, হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী ও বঙ্গোপসাগর ঘেরা ওই এলাকার মানুষ ভেবেছিলেন, আর বুঝি নদীনালা পেরিয়ে দূরের হাসপাতালে যেতে হবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে আর কোনও স্থায়ী চিকিৎসকের দেখা নেই।
১৯৯৭ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আধুনিকরণ করা হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রায় ১ কোটি টাকায় অপারেশন থিয়েটার, লেবার রুমের সমস্ত রকম সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল। চালু হয়েছিল ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু সে সবই অতীত। সমস্ত মূল্যবান সরঞ্জামগুলি নষ্ট হচ্ছে। ব্যবহার না হওয়ায় চিকিৎসকদের আবাসনগুলিও ভেঙে পড়ছে। বর্তমানে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালাচ্ছেন ৪ জন নার্স, ১ জন ফার্মাসিস্ট। রয়েছেন কয়েক জন সাফাই কর্মী।
ওই পঞ্চায়েতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বাস। তাঁদের এক সময়ে সম্পূর্ণ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভর করতে হত। সে সময়ে চিকিৎসক ছিলেন। ভিড়ও হত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বাড়াবাড়ি কিছু হলে এখানে কেউ আসেন না। চিনাই নদী পার হয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের দ্বারিকনগর গ্রামীণ হাসপাতাল বা আরও কিছু দূরের কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে যেতে হয়।
বাসিন্দাদের দাবি, চিকিৎসকের অভাবে এত বড় দ্বীপের মানুষের হয়রানির শেষ নেই। দিনের বেলায় কোনও বিপজ্জনক রোগীকে নিয়ে নদী পার হয়ে অন্য হাসপাতালে পৌঁছনো যায়। কিন্তু রাতে চোখের সামনে দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও কিছু করার থাকে না। কিছু দিন আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে এসেছিল বিধানসভার সাবজেক্ট কমিটির প্রতিনিধির দল। তাঁদের কাছে স্থায়ী চিকিৎসকের আবেদন জানানো হয়েছে। প্রতিশ্রুতি মিললেও কবে সত্যিই তা বাস্তবায়িত হয়, সে দিকে তাকিয়ে দ্বীপবাসী।