সালটা ২০১১। এম এসসি ফাইনালের শেষ সেমেস্টারের রেজ়াল্টের অপেক্ষা করছি। তখনই সুখবর পেলাম। এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছি। মধ্যবিত্ত পরিবারে মাস্টার্স শেষ করতে না করতেই সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো সৌভাগ্যের খবরে স্বভাবতই বাড়িতে খুশির হাওয়া বয়ে গেল। এরপর এল বহু আকাঙ্ক্ষিত কাউন্সেলিংয়ের দিন। আজীবন যাদবপুরে বড় হওয়া আমি চাকরি পেলাম সাগরদ্বীপের এক প্রত্যন্ত স্কুলে। থমথমে মুখে বাড়ি ফিরলাম। জয়েন করা নিয়ে দোলাচলে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু এত প্রতিযোগিতা পেরিয়ে সরকারি চাকরি পেয়েও না করার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারিনি।
পার্শ্বশিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম স্কুলে। আমার বাড়ি থেকে সাগরদ্বীপের ওই স্কুলে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। ট্রেন, বাস, ভেসেল পেরিয়ে স্কুলে পৌঁছতাম প্রায় সাড়ে ১০টায়। বলাবাহুল্য, পথে বাথরুমে যাওয়ার কোনও সুযোগই নেই। সকালে উঠে এক কাপ চা-ও খেতাম ভয়ে ভয়ে। রাস্তায় যদি টয়লেট পায়! স্টেশনে বা ভেসেল ঘাটে টয়লেট আছে বটে, কিন্তু বাথরুমগুলির এতটাই দুরবস্থা, সেখানে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। নিরুপায় না হলে প্রায় কোনও শিক্ষিকাই ওই বাথরুম ব্যবহার করতেন না। টয়লেট চেপে রাখা, নোংরা বাথরুম ব্যবহার যে ইউটিআই বা ইকোলাইয়ের মতো সমস্যার অন্যতম কারণ, তা জানা সত্ত্বেও কিছু উপায় থাকত না।
প্রথম দিন স্কুলে জয়েন করার পরে বাথরুমে যাওয়ার ঘটনা আজও মনে আছে। আমি যেই স্কুলে পড়াতাম, সেটি মেয়েদের স্কুল। মেয়েদের আলাদা বাথরুম, শিক্ষিকাদের জন্য একটি আলাদা বাথরুম ছিল। বাথরুমে ঢুকে দেখলাম একদিকে কমোড, অন্যদিকে বেসিন। কিন্তু কোনও জলের ব্যবস্থা নেই। তড়িঘড়ি আবার বেরিয়ে এলাম! একজন কলিগকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বাথরুমের পিছনের পুকুর থেকে জল নিয়ে বাথরুমে যেতে হবে। বলাইবাহুল্য, পুকুরের জল মোটেই পরিষ্কার নয়। স্কুলের চত্বরে নলকূপ আছে, পরিষ্কার জল পেতে হলে জল বয়ে আনতে হবে ওখান থেকে। শুধু শিক্ষিকারা কেন, স্কুলের ছোট ছোট মেয়েদেরও একই হাল। বেশিরভাগ সময়েই স্কুলের মেয়েরা পরিশ্রম বাঁচাতে ওই পুকুরের জলই ব্যবহার করত।
টয়লেটের পরে পরিষ্কার জল ব্যবহার যে কতটা জরুরি, সে সম্পর্কে ওদের ধারণাও ছিল না। পিরিয়ড চলাকালীন অতক্ষণ জার্নির ধকল, পেট ব্যথা সত্ত্বেও টিউবওয়েলে জল পাম্প করে, বালতি বয়ে নিয়ে গেলে তবেই পরিষ্কার জল মিলত। তাই অনেক সময়েই স্কুলে থাকাকালীন বাথরুমেই যেতাম না। চাকরি পাওয়ার পর প্রথম যে বাড়িটায় ভাড়া থাকতাম, সেখানে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সাগরের একমাত্র রুদ্রনগর এলাকায় সন্ধে ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কারেন্ট থাকত। ফলে কল থেকে জল পাওয়ার প্রশ্নই নেই। এখানেও সেই পুকুরের জলই ভরসা। দু’পাশে বাগানের মাঝে ইটের বাঁধানো পথে বেশ কিছুটা গেলে পুকুর। সেখান থেকে জল টেনে এনে বাথরুমে যেতে হত। ওই একই জলে বাসন মাজা, কাপড় কাচা সবই চলত। কত দিন হয়েছে স্নানের জল আনতে গিয়ে দেখি জলের উপর বাসন ধোওয়া তেল ভাসছে। হাত দিয়ে তেল সরিয়ে স্নানের জল তুলতাম। ওই একই জল ব্যবহার করতে হত টয়লেটে।
দূরত্ব, দিনের পর দিন পরিবারের থেকে দূরে থাকা, যাতায়াতের পরিশ্রম, সব বাদ দিলেও শরীরের সঙ্গে আপস করা সব সময়ে সম্ভব হয় না। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, শিক্ষিকাদের অধিক সংখ্যায় স্ত্রী-রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা মোটেই আশ্চর্জজনক নয় বরং ‘আতঙ্কিত’ হওয়ার মতোই।