পুকুরে তৈরি সুইমিং পুলে সাঁতার শিখছে শিশুরা। মৈপিঠের বৈকু্ন্ঠপুরে। নিজস্ব চিত্র
সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায় জলে ডুবে বহু শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকে জলে ডুবে শিশু মত্যুর হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। গোটা দেশ জুড়েই এ ধরনের মৃত্যু হার বেশি বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে মিলে সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লকে গত কয়েক বছর ধরেই জলে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করছে। তার সুফলও মিলছে বলেই দাবি উদ্যোক্তাদের একাংশের। জলে ডোবা প্রতিরোধে সেই সব কাজ খতিয়ে দেখতেই সোমবার কুলতলির মৈপিঠে আসেন কেন্দ্রীয় দল ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। ছিলেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধিও। জলে ডুবে মৃত্যু আটকাতে সুন্দরবন মডেল গোটা দেশ জুড়ে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
২০২১ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে জলে ডুবে শিশু মৃত্যুর সমীক্ষায় একটি কমিটি গঠন করে। প্রাথমিকভাবে বিহার ও তামিলনাড়ুর কয়েকটি জায়গা বেছে সমীক্ষা চালায় ওই কমিটি। তাতে মারাত্মক তথ্য সামনে আসে। দেখা যায়, ওই এলাগুলিতে এক বছরে শতাধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে। প্রশাসন সূত্রের খবর, জলে ডুবে শিশু মারা গেলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই মৃত্যু নথিভুক্ত হয় না। ফলে বিষয়টি প্রশাসনের নজরের আড়ালে থেকে যায়। কিন্তু সমীক্ষার তথ্য দেখেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। দেশজুড়ে সমীক্ষার পাশাপাশি এ ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই কমিটিকে।
পরবর্তীকালে দেখা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় ওই সংস্থার সমীক্ষা শুরুর আগে থেকেই অবশ্য আন্তর্জাতিক ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন ব্লকে জলে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছিল। প্রাথমিকভাবে গ্রামে গ্রামে মানুষকে সচেতন করা হয়। বাড়ি সংলগ্ন পুকুর ঘিরে রাখতে বলা হয়। এরপর একাধিক জায়গায় শুরু হয় কবচ নামে একটি প্রকল্প। সংস্থা সূত্রের খবর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাবা-মা কাজে চলে গেলে বা ব্যস্ত থাকলে, সেই সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শিশুটি। কবচ প্রকল্পের মাধ্যমে বাবা-মায়েদের অবর্তমানে শিশুদের এক জায়গায় রেখে দেখাশানার ব্যবস্থা হয়। বাবা মায়েরা সকালে কাজে যাওয়ার সময় শিশুদের এখানে রেখে যান। পরে কাজ থেকে ফিরে আবার নিয়ে যান। এর পাশাপাশি গ্রামের কিছু মানুষকে বাছাই করে প্রাথমিক চিকিৎসার পাঠ দেওয়া হয়। জলে ডোবা শিশুকে উদ্ধারের পর ঝাড়-ফুঁক না করে কী ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া উচিত, তা শেখানো হয় তাঁদের। এর ফলও মেলে হাতে নাতে। সম্প্রতি মৈপিঠেই জলে ডোবা কিশোরকে জল থেকে তুলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাঁচান প্রশিক্ষণ পাওয়া এক গ্রামবাসী।
সম্প্রতি ওই সংস্থার উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পুকুর ভিত্তিক সুইমিং পুল। বাঁশের বেড়া দিয়ে পুকুরের একাংশ ঘিরে, তার মধ্যে বাঁশের মাচা বেঁধে জলের গভীরতা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এখানে সহজেই সাঁতার শিখতে পারবে। থাকবে প্রশিক্ষকও। ছোটবেলায় সাঁতার শিখে গেলে জলে ডুবে মৃত্যু হার অনেকটাই কমবে বলে দাবি সংস্থার। মৈপিঠের ভুবনেশ্বরী ও বৈকুন্ঠপুরে এরকমই দু’টি পুকুর ভিত্তিক সুইমিং পুলের উদ্বোধন হয় সোমবার। সংস্থার তরফে সুজয় রায় বলেন, “জলে ডোবা প্রতিরোধে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবার এই পুকুর ভিত্তিক সুইমিং পুল চালু করা হল। এ ধরনের সুইমিং পুল ভারতে প্রথম।”
এ দিন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা মৈপিঠে এসে কবচ প্রকল্প, পুকুর ভিত্তিক সুইমিং পুল খতিয়ে দেখেন। এলাকায় জলে ডুবে মৃত শিশুর পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা। পরে জলে ডোবা প্রতিরোধে শিশুদের নিয়ে একটি পদযাত্রায়ও অংশ নেন তাঁরা। কমিটির অন্যতম সদস্য নতুন দিল্লির এইমসের এমার্জেন্সি বিভাগের প্রফেসর তেজপ্রকাশ সিংহ বলেন, “জলে ডুবে মত্যুর দিকে বহু দিন পর্যন্ত প্রশাসন সেভাবে নজর দেয়নি। সম্প্রতি সমীক্ষার পর সকলেই নড়েচড়ে বসেছে। কী ভাবে এই মৃত্যু আটকানো যায়, তার পরিকল্পনা চলছে। এখানে এ ব্যাপারে খুব ভাল কাজ হচ্ছে আগামিদিনে এই মডেল গোটা দেশেই চালু করা যেতে পারে। সুন্দরবন তথা বাংলার জন্য এটা গর্বের।”