শিক্ষকের অভাবে স্কুল ছাড়ছে পড়ুয়ারা। — ফাইল চিত্র।
শিক্ষার অধিকার আইনের সঠিক প্রয়োগের লক্ষ্যে ২০১০ সাল নাগাদ জেলায় জেলায় জুনিয়র হাইস্কুল বা উচ্চ প্রাথমিক স্কুল চালু করা হয়। এই সব স্কুল গড়ার ক্ষেত্রে নিয়ম, গ্রামে ২ কিলোমিটারের মধ্যে যদি হাই স্কুল না থাকে, তা হলে সেখানে জুনিয়র হাই স্কুল করা যাবে। স্কুলগুলিতে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত স্কুলছুট আটকাতেই এগুলি গড়া হয়।
তবে বিভিন্ন কারণে স্কুলগুলিতে ভর্তি হতে পড়ুয়াদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ, পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব। বর্তমানে শিক্ষক সঙ্কটের পাশাপাশি পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে একাধিক জুনিয়র হাই স্কুল।
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে ২০১০ সাল নাগাদ ১৯টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল গড়ে ওঠে। বর্তমানে ১৬টি স্কুল চালু রয়েছে। পড়ুয়ার সংখ্যা মাত্র ১১৭ জন। অর্থাৎ, গড়ে মাত্র ৭ জন করে পড়ুয়া রয়েছে এক একটি স্কুলে।
এই ব্লকেরই যোগেশগঞ্জ আদর্শ উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে বর্তমানে কোনও পড়ুয়া নেই। স্কুলের অতিথি শিক্ষক বলেন, ‘‘কিছু দিন আগে পর্যন্ত ২-৪ জন পড়ুয়াকে খুব চেষ্টা করে ধরে রাখা হয়েছিল। তারাও অন্য স্কুলে চলে গিয়েছে। স্কুল বন্ধ করার জন্য ব্লক প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছি।’’ তিনি জানান, এই স্কুলে ২০১১ সালের নাগাদ কয়েক জন স্থায়ী শিক্ষক ছিলেন। ক্রমশ তাঁরা অন্যত্র চলে যান। কেউ অবসর নেন। গত কয়েক বছর ধরে এক জনই অতিথি শিক্ষক রয়েছেন।
প্রথম দিকে জনা ২০ পড়ুয়া থাকলেও শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পড়ুয়ারাও এই স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তিনি আরও জানান, এই স্কুলের সামনেই একটি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। সেখানে প্রায় ১০০ জন পড়ুয়া আছে। চতুর্থ শ্রেণির পরে তারাও এখানে ভর্তি না হয়ে কিছুটা দূরে যোগেশগঞ্জ হাইস্কুলে চলে যায়।
এই ব্লকের শ্রীধরকাটি পশ্চিমপাড়া উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে দু’জন স্থায়ী শিক্ষক আছেন। পড়ুয়ার সংখ্যা গত কয়েক বছর ধরে দশের মধ্যে আটকে। এখানেও স্কুলের পাশেই প্রাথমিক স্কুল থাকলেও পড়ুয়ারা দূরের হাই স্কুলেই ভর্তি হয়। এক শিক্ষক বলেন, ‘‘অভিভাবকদের অনেক বুঝিয়ে ১০ জন পড়ুয়া আনা গিয়েছে। কিন্তু ওদের শাসন করতেও ভয় লাগে। হয় তো স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেবে!’’
সন্দেশখালি ২ ব্লকে ৪টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল চালু আছে। ৩টি স্কুল ছাত্র ও শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে ব্লক জুড়ে উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া রয়েছে ১৪০ জন। এই ব্লকের কোনও উচ্চ প্রাথমিকে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনও স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। সবই চলছে অতিথি শিক্ষক দিয়ে।
অতিথি শিক্ষকেরা অবসর নেওয়ায় এই ব্লকের দাউদপুর জ্যোতিষপুর উচ্চ প্রাথমিক স্কুলটি বন্ধের মুখে পড়ে। একটি প্রাথমিক স্কুল থেকে শিক্ষক এনে কোনও রকমে স্কুলটি চালু রাখা হয়েছে। স্কুলটির কাছেই পরিবার নিয়ে থাকেন রমেশ মণ্ডল। প্রাথমিক স্কুলের পরে তিনি ছেলেকে ভর্তি করেছেন কিছুটা দূরের হাইস্কুলে। তিনি বলেন, ‘‘এই স্কুলে শিক্ষক নেই, তেমন কোনও পরিকাঠামোও নেই। তাই ছেলেকে কিছুটা দূরে দাউদপুর এইস এল শিক্ষা নিকেতনে ভর্তি করেছি। ওখানে তবু পড়াশোনা হয়। তা ছাড়া, এখানে ভর্তি করলেও তো আবার অষ্টম শ্রেণির পরে হাই স্কুলে ভর্তি করতেই হত।’’
সন্দেশখালি ১ ব্লকে ১৬টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল আছে। এখানে হাইস্কুলের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা কিছুটা বেশি। হাসনাবাদ ব্লকে ৯টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল আছে। পড়ুয়া ৩৭০ জন।
গোটা বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী অধ্যাপক কুমার রানা বলেন, ‘‘প্রথমে দেখা দরকার, এই স্কুলগুলিতে কেন পড়ুয়ারা ভর্তি হতে চাইছে না। শিক্ষার্থীর বাড়ির কাছে স্কুল গড়ার পাশাপাশি পড়াশোনার উপযুক্ত পরিকাঠামোও গড়ে তোলা জরুরি। তা ছাড়া, স্কুলগুলিতে শিক্ষকদের বণ্টন সঠিক ভাবে হওয়া দরকার। এক একটি ক্লাসের জন্য অন্তত এক জন করে শিক্ষক যেন থাকেন, তা দেখতে হবে।’’ স্কুলে পড়াশোনা প্রতি নিয়মিত নজরদারি এবং সে কাজে স্থানীয় মানুষদেরও শামিল করা প্রয়োজন বলে তাঁরমত।
এ বিষয়ে উত্তর ২৪ পরগনার ডিআই কৌশিক রায়কে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি।