শিশুকন্যাকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল। বাসন্তীতে। ফাইল চিত্র।
মহিলাদের উপরে কোনও ধরনের নিগ্রহ, নির্যাতন বরদাস্ত করবেন না বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু জেলায় পরিস্থিতি কী? পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় কতটা সন্তুষ্ট মানুষ? মহিলাদের উপরে ঘটা অন্যায়ের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তৈরি হয়েছিল মহিলা থানা। তারাই বা কতটা পদক্ষেপ করছে? আজ দক্ষিণ ২৪ পরগনা
তিন বছর আগে কুলতলির বাসিন্দা এক তরুণীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফরাক্কার যুবকের। বিয়ের পরে কুলতলিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। অভিযোগ, দিন কয়েক পর থেকেই তরুণীর উপরে নানা ভাবে অত্যাচার চালাতে শুরু করে স্বামী। অভিযোগ, বছরখানেক আগে স্ত্রীকে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও করে সে। গরম তেল ঢেলে পুড়িয়ে দেয় স্ত্রীকে। তারপরে রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডারের সঙ্গে বেঁধে দরজা বন্ধ করে পালায়। যুবক ভেবেছিল, সিলিন্ডার ফেটে মারা যাবে স্ত্রী। কিন্তু কোনওরকমে বাঁধন খুলে বেরিয়ে আসেন তরুণী। ফোন করে এক আত্মীয়কে ডেকে পৌঁছন ব্লক হাসপাতালে। শুরু হয় চিকিৎসা।
সুস্থ হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে কুলতলি থানায় অভিযোগ করেন। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ তেমন তৎপরতা দেখায়নি বলে অভিযোগ। তবে হাল ছাড়েননি তরুণী। শেষ পর্যন্ত ওই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এলাকা-ছাড়া ওই যুবককে ফোন করে ডেকে এনে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেন তরুণীই।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামীণ এলাকাগুলিতে নারী নির্যাতনের এমন ঘটনা ঘটছে ভুরি ভুরি। কিন্তু ওই তরুণীর মতো রুখে দাঁড়ানোর উদাহরণ প্রায় নেই বলেই দাবি নারী ও শিশু সুরক্ষায় কাজ করা সংগঠনগুলির। সম্প্রতি নারী নির্যাতনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের উপরমহলকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু অনেকেরই দাবি, জেলা জুড়ে যে পরিমাণ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার বেশিরভাগই থানা পর্যন্ত পৌঁছয় না।
বারুইপুর মহকুমা এলাকায় দীর্ঘদিন নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য স্মিতা সেন বলেন, “গত এক-দেড় বছরে নারী নির্যাতন, গার্হস্থ্য হিংসা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। করোনা অতিমারি পরিস্থিতিতে এটা আর এক ধরনের অতিমারির চেহারা নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যে বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছেন, এটা ভাল দিক। কিন্তু নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনাই থানা পর্যন্ত পৌছয় না। সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে মহিলারা মুখ বুজে সব সহ্য করে নেন।”
অনেক ক্ষেত্রে পুলিশি উদাসীনতার অভিযোগও রয়েছে। ক্যানিং মহকুমা এলাকায় নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা এক মহিলা সমিতির সদস্য আমিনা লস্কর বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগ পর্যন্ত নিতে চায় না। অপমানজনক কথা বলে অভিযোগকারিণীকে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়।”
একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত দেড় বছরে মহিলাদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। কুলতলি ব্লক হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত বছর লকডাউন জারি হওয়ার পরে প্রথম পাঁচ মাসে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন প্রায় একশোজন। তাঁদের মধ্যে বড় অংশই মহিলা। অনেকের মৃত্যু হয়। কুলতলি ব্লক হাসপাতালের অন্বেষা ক্লিনিকের কাউন্সেলর সুপর্ণা কণ্ঠ বলেন, “এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, গ্রামীণ এলাকায় কী পরিমাণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালে এলেও পুলিশে অভিযোগ করতে চান না প্রায় কেউই। অনেককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে জানতে পারি, নানা চাপে তিনি অভিযোগ তুলে নিয়েছেন।”
মহিলাদের সুরক্ষার কথা ভেবে বছর কয়েক হল বারুইপুর, ক্যানিং ও ডায়মন্ড হারবার মহকুমায় একটি করে মহিলা থানা তৈরি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা নির্যাতনের পরে সরাসরি মহিলা থানায় যোগাযোগ করেছেন। পুলিশ ব্যবস্থাও নিয়েছে। তবে তাতে সামগ্রিক পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সদস্য মিঠুন মণ্ডল বলেন, “এটা ঠিক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিতারা থানা পর্যন্ত যেতে চান না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামে সালিশি সভা ডেকেই বিষয়টা মিটিয়ে নেওয়া হয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও থাকে। থানায় গেলেই যে সব সময় সঠিক বিচার পান, তা-ও নয়। পুলিশ-প্রশাসন মিলে অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে দেয়।” বারুইপুর পুলিশ জেলার এক কর্তা অবশ্য বলেন, “নারী নির্যাতনের অভিযোগ এলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
কুলতলির সেই নির্যাতিতা তরুণী এখন একাই থাকেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সেলাইয়ের কাজ করে স্বনির্ভরতার দিশা খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “মেয়েরাই পারে মেয়েদের উপরে হওয়া এই নির্যাতন বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ানোই একমাত্র পথ। আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।”